Advertisement
০৮ মে ২০২৪

খেয়ালি পদ্মায় অগোছালো সীমান্ত যেন মিনি পাকিস্তান

গোয়েন্দারা বলছেন রাজশাহি আর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েই খাগড়াগড়ে তৈরি বোমা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে জঙ্গিরা। তত্ত্ব-তালাশে সেখানে যাচ্ছে এনআইএ-র দল। তার আগে পড়শি দেশের ওই দু’জায়গা ঘুরে সীমান্ত পারের পাচার-চিত্র দেখে এল আনন্দবাজার।পণ্যে ঠাসা একটা নৌকা এসে ভিড়ল পদ্মার পাড়ে। গলুই থেকে দু’জন লাফিয়ে পাড়ে উঠতেই এক দল লোক ছেঁকে ধরল তাদের। বাজারের চেনা দৃশ্য তফাৎটা কেবল সব কিছুই ঘটে চলল ভীষণ নিঃসাড়ে। সুনসান আলাপ। এক দল লোক মাথায় গামছা জড়াতে জড়াতে নৌকায় উঠে গেল মাল নামাতে। পাড়েই দাঁড়িয়ে রইল কয়েক জন। সবাই কাজ করে চলে খুব দ্রুত গতিতে, কিন্তু মুখ বুজে। পদ্মার মধ্যিখানে চর থেকে এসেছে এই নৌকা। সে চরের নাম আষাঢ়িয়াদহ। তার পাশে আলাতুলি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে জামাতের আগুনে পুড়ে ছারখার বিদ্যুৎকেন্দ্র।—নিজস্ব চিত্র।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে জামাতের আগুনে পুড়ে ছারখার বিদ্যুৎকেন্দ্র।—নিজস্ব চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
রাজশাহি শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৪ ১০:৩৬
Share: Save:

পণ্যে ঠাসা একটা নৌকা এসে ভিড়ল পদ্মার পাড়ে। গলুই থেকে দু’জন লাফিয়ে পাড়ে উঠতেই এক দল লোক ছেঁকে ধরল তাদের। বাজারের চেনা দৃশ্য তফাৎটা কেবল সব কিছুই ঘটে চলল ভীষণ নিঃসাড়ে। সুনসান আলাপ। এক দল লোক মাথায় গামছা জড়াতে জড়াতে নৌকায় উঠে গেল মাল নামাতে। পাড়েই দাঁড়িয়ে রইল কয়েক জন। সবাই কাজ করে চলে খুব দ্রুত গতিতে, কিন্তু মুখ বুজে। পদ্মার মধ্যিখানে চর থেকে এসেছে এই নৌকা। সে চরের নাম আষাঢ়িয়াদহ। তার পাশে আলাতুলি।

রাজশাহি শহরের কোল ঘেঁষে পদ্মা নেমে গিয়েছে দখিনে। রাজশাহির উত্তর পশ্চিমে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলাদেশে ঢোকা এ নদীর খেয়ালি চলন। এক দফায় বাংলাদেশে ঢুকে কয়েক কিলোমিটার এগিয়েই বুঝি মনে পড়েছে ভারতের কথা। গতিপথ পাল্টে আবার গিয়ে ঢুকেছে ভারতে। অচিরেই ফের বাংলাদেশে ঢুকে যেন মতিস্থির হয়েছে, সাড়া-সাপ্টা বয়ে গিয়েছে সমুদ্র অভিমুখে। পদ্মার দু’পাড় এখানে দুদ্দাড় ভাঙে। আর নদীর মধ্যিখানে গজিয়ে ওঠে চর।

খেয়ালি পদ্মার দু’দেশে এই আনাগোনাই গুলিয়ে দিয়েছে সীমান্ত গুছিয়ে রাখার কাজটা। আর সেই সুযোগে এই এলাকা হয়ে উঠেছে চোরাচালানের মুক্তাঞ্চল। কাঁটা তারের বেড়ায় এখান দিয়ে গরু চালান এখন প্রায় বন্ধ। কিন্তু ফেনসিডিল, হেরোইন, অস্ত্রশস্ত্রের আনাগোনা আজও দেদার। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে তৈরি শক্তিশালী বিস্ফোরকও জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) জঙ্গিরা যে দুই পথে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছে, তার একটি ঠিক এইখানে পদ্মা উজিয়ে।

রাজশাহির শহুরে কোলাহল থেকে পদ্মাকে পাশে নিয়ে রাস্তা ছুটেছে উত্তরে। নদীর এ-পারে গোদাগাড়ি, ও-পারে মুর্শিদাবাদের লালগোলা। গোদাগাড়ি পেরিয়ে রাজাবাড়ি হয়ে সুলতানগঞ্জ। পদ্মাই সীমান্ত। ঘাটে ঘাটে নৌকো লাগছে। চর থেকে আসা নৌকো। সেই চর আষাঢ়িয়াদহ, আলাতুলি। আলাতুলির চরে গড়ে ওঠা গ্রাম কোদালকাঠি। বোঁচকা মাথায় অস্বাভাবিক দ্রুততায় রাস্তা ডিঙিয়ে রাজাবাড়ির মোকামে ঢুকে যায় নাইয়ারা। গাড়ি থামাতেই ঘিরে ধরে সতর্ক চাউনি। আলগোছে ঘোরাঘুরি কাঁধে রাইফেল জংলা-পোশাক বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)-র। চোরাচালান শব্দটা যেন কেউ শোনেইনি জীবনে!

গোদাগাড়ির ঘাটে বাঁধা খালি নৌকায় ওঠার আগে দোকানের গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন সওকত শেখ। সফরসঙ্গী রাজশাহির এক সাংবাদিকের পূর্বপরিচিত, পুলিশের খাতায় ‘প্রাক্তন জেএমবি জঙ্গি’। বাড়ি চর আষাঢ়িয়াদহে। জানালেন, চাষের পাট মোকামে বেচে ফিরছেন। শুধুই পাট? ইশারা ধরে নিলেন দ্রুত। বললেন, “ও সব যারা করে তারা করে, আমি না।” যা শোনা যায়, তা হলে তা সত্যি? হাসলেন যুবক। “আজ্ঞে হ্যা।ঁ ভুল কিছু নয়।” কী কী চোরাচালান হয়? মাথা ঘুরিয়ে আশপাশ মেপে নিয়ে বললেন, “এখন হেরোইন আর স্বর্ণ। সঙ্গে কিছু মদ, ফেনসিডিল...” আর বিস্ফোরক? সে সবও আসে নাকি? গলার গামছা আলগোছে মাথায় ফেলে কাছ ঘেঁষে আসে সওকত। চাপা গলায় বলে, “গেল মাসেও এসেছে। বেশ কয়েক দফায়। এখন বন্ধ। তবে বিহারের বন্দুক রোজই আসছে। ওয়ান শটারই বেশি। সঙ্গে টোটা। নানা কিসিমের।”

সওকত বলে, চরে অনেক গুদাম। রাতবিরেতে বা ভোরবেলায় ভারতের সীমান্ত টপকে ‘মাল’ এসে জড়ো হয় সেখানে। চর থেকেই সময়-সুযোগ অনুযায়ী তা নৌকা করে আনা হয় রাজাবাড়ি থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ছড়ানো নানা মোকামে। মাথা কারা? আরও ঘন হয় সওকতের গলার স্বর, “সব মোদাচ্ছের, গোলাম আজম আর কিবরিয়ার লোক।” তারা কারা? এ বার ধরতাই সফরসঙ্গীর, “তিন জনই জামাতের প্রভাবশালী নেতা। আবার জেএমবি-রও সংগঠক। অস্ত্র আর মাদক চোরাচালান এখন এরাই নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশ থেকে সাংবাদিক সবাই রয়েছে এদের পে-রোলে।” ঘাড় নাড়েন সওকত, ঠিক! তবে মানতে নারাজ জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয় নেতা আতাউর রহমান। “জামাত ইমানে বিশ্বাসী, চোরাচালানে তাদের কোনও নেতা-কর্মী যুক্ত হয় না,” দাবি প্রবীণ এই নেতার।

আরও এগিয়ে মহানন্দার ওপর শহিদ জাহাঙ্গির সেতু পেরিয়ে রাজশাহি জেলা শেষ। নতুন জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কানসাট হয়ে সোনা মসজিদ ছুঁয়ে রাস্তা পৌঁছে যায় শিবগঞ্জ স্থলসীমান্ত বন্দরে। উল্টো দিকে মালদহ জেলার মহদিপুর। ভারতীয় ট্রাকে পণ্য আসছে সাদা পথে, পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে যাতায়াত মানুষেরও। অভিবাসন অফিসার জানালেন, এখন রোজ শ’দুয়েক ট্রাক আসে ভারত থেকে। তবে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হলেই গুরুত্ব বাড়বে এই স্থল বন্দরের। পাকুড় থেকে রোজ পাঁচশো ট্রাক পাথর ঢুকবে বাংলাদেশে। তার জন্য রাস্তা চওড়া হচ্ছে দু’দিকেই।

রাজশাহি থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত সীমান্ত ঘেঁষা ৮৩ কিলোমিটার রাস্তার দু’দিকের এই জনপদের কিন্তু আরও একটি পরিচিতি আছে। অনেকে বলেন ‘মিনি পাকিস্তান’। জেএমবি জঙ্গিদের মুক্তাঞ্চল ছিল এই এলাকা। বছর খানেক আগে দলের নেতাদের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিল জামাতে ইসলামি। জামাত ক্যাডারদের ভয়ানক সন্ত্রাসে ছারখার হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। রাস্তা কেটে, গাছ ফেলে পুলিশকে আটকে প্রশাসন কার্যত দখল করে নিয়েছিল জামাত। টানা তিন-চার দিন এখানে ঢুকতে পারেনি বাইরের কেউ। যাত্রী নামিয়ে একটা গোটা ট্রেন বারুদ ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কানসাটে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় গোটা একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র। তার গুদামে রাখা কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ বণ্টনের সরঞ্জাম, কর্মীদের আবাসন, অফিসঘর, অজস্র গাড়ি কানসাটের মানুষ সারা দিন শুধু বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছিলেন সে দিন।

তার পরে কড়া পুলিশি অভিযানে আপাতত সন্ত্রাস থেকে দূরে থাকার কৌশল নিয়েছে জামাত। তবে এলাকা দখলে রেখে চোরাচালানের লাগাম আজও কষে ধরে রেখেছে তারা। ৫ জানুযারির নির্বাচনে বিএনপি-জামাত অংশ না-নেওয়ায় এই গোদাগাড়ি-তানড় সংসদীয় আসনটিতে জিতেছেন আওয়ামি লিগ প্রার্থী গোলাম রব্বানি। জানালেন, ভারত থেকে বিস্ফোরক আসার খবর তাঁরা পাচ্ছিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে যে ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার পরে এ বিষয়টি এক রকম নিশ্চিত। কারণ গোটা বাংলাদেশ পেরিয়ে সীমান্ত লাগোয়া কানসাটে এত বিস্ফোরক নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

তার পরেও আপনারা সতর্ক হননি? সীমান্ত রক্ষীদের সক্রিয় করেননি?

সাংসদ বললেন, “করেছি। সবাই এখন সতর্ক। একেবারে বন্ধ না-হলেও চোরাচালান কমেছে।”

বললেন বটে, কিন্ত সে কথায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ একেবারেই নেই। নিজের এলাকাতেও যে তাঁকে ঘোরাফেরা করতে হয় সামনে পিছনে পুলিশি গাড়ির পাহারা নিয়ে!

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE