Advertisement
০৬ মে ২০২৪

মোদী-শরিফ কথা হলেও এখনও অস্পষ্ট ভারতের অবস্থান

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বৈঠকের আটচল্লিশ ঘন্টা অতিবাহিত হতে না হতেই কূটনৈতিক মহলে পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের অবস্থানের অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ১৯:৫০
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বৈঠকের আটচল্লিশ ঘন্টা অতিবাহিত হতে না হতেই কূটনৈতিক মহলে পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের অবস্থানের অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল।

মোদী-নওয়াজ বৈঠক হলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হচ্ছে, এই বৈঠকের ফলে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়ে গেল, তা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। শান্তিপ্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী আগ্রহী— সেই বার্তা দিয়েছেন বটে। কিন্তু, সেই বন্ধ ঘরের কূটনীতির মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়ে গেল এবং কাশ্মীর থেকে সিয়াচেন, সন্ত্রাস থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম— সব ব্যপারে যে কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কূটনীতিকরা বলছেন, আলাপ-আলোচনা (ডায়ালগ) এবং যোগাযোগ রক্ষা (এনগেজমেন্ট) দু’টি ভিন্ন বিষয়। এ বারের বৈঠকটি শীর্ষ স্তরে হলেও আসল আলোচনা হবে দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ে। এবং অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার আসন্ন বৈঠকে।

দু’দেশেরই কূটনৈতিক মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এটি যদি আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা নয়, তবে শুধুমাত্র ফিল-গুড ফ্যাক্টর তৈরি করার জন্য এই বৈঠক কি খুব জরুরী ছিল? নাকি এই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে আসলে পাকিস্তান সম্পর্কে মোদী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির দোদুল্যমানতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক বিবেক কাটজু জানান, পাকিস্তানের সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম নিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ভারত সরকার একটা রেডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। এবং এ ব্যপারে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জানিয়ে দিয়েছে, পাক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভারতের হুরিয়তদের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। যে জন্য দু’দেশের মধ্যে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত সরকার নিজেই তড়িঘড়ি করে এই রেড-লাইন অতিক্রম করল কেন? কোন আশ্বাসের ভিত্তিতে? পাকিস্তান এমন কী করেছে যে তাদের উপর ভারত আস্থা রাখতে পারে?

কূটনীতিকদের মধ্যে এই বৈঠক নিয়ে তাই বিতর্ক শুরু হয়েছে। একটি মত হল, আলাপ-আলোচনার পথে দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রকে যাবে, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রথমে যুগ্মসচিব ও বিদেশসচিব পর্যায়ে আলোচনা করে তার পর রাষ্ট্রপ্রধানদের স্তরে আলোচনা করাটা কি বাঞ্চনীয় নয়? এ ক্ষেত্রে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠক করা হল কেন? এটি তো স্নাযুর চাপের কূটনীতিতে পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়া! অন্য মতটি দিচ্ছেন এ দেশের বিদেশসচিব জয়শঙ্কর। তাঁর বক্তব্য হল, দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যে কোনও সময়ই বৈঠক করতে পারেন, কথা বলতে পারেন। তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্তরে সামগ্রিক ভাবে কথোপকথনের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না। আর দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি না-ও থাকতে পারে। কিন্তু, এই বৈঠক সবসময়ই আস্থাবর্ধক। যা দ্বিপাক্ষিক বৈঠককে তরান্বিত করতে সাহায্য করে।

১৯৯৫ সালের মে মাসে পাক প্রেসিডেন্ট লেঘারি এসেছিলেন দিল্লিতে। তিনি হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দারা তখন আপত্তি তোলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও গোয়েন্দাকর্তা দুলতকে বলেছিলেন, হুরিয়তদের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। সেই দেখা করলে আপত্তির কী আছে? সেটাই প্রথম হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে পাক রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠক। ’৯৮ সালে দু’দেশের মধ্যে সংযুক্ত ভাবে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু এত বছর পরেও শ্যাম রাখি না কুল— তা নিয়ে ভারতের দোলাচল এখনও থামেনি।

এর ফলে শুধু কংগ্রেস বা বিরোধী প্রতিপক্ষ নয়, আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যেও সন্দেহ ও শঙ্কা রয়েছে। বিশেষত নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। বাজপেয়ী বার বার বলতেন, গরম দুধ একটু ফুঁ দিয়ে খাওয়া ভাল। তা না হলে জিভ পুড়ে যেতে পারে। এখন নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও সে দেশের বিরোধী প্রতিপক্ষ প্রশ্ন তুলেছে যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কোথায়? এবং যৌথ বিবৃতিতেও কাশ্মীর শব্দটির অনুপস্থিতি সে দেশের মধ্যেও সমস্যা বাড়িয়েছে। ঈদের পরেই প্রধানমন্ত্রী জম্মু-কাশ্মীরের জন্য ৭০ হাজার কোটি টাকার বড় প্যাকেজ ঘোষণা করতে চলেছেন।

এটি খুব পরিস্কার যে জম্মু-কাশ্মীরের জন্য এই সহায়তার কথা বলে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও তিনি একটি বিশেষ বার্তা দিতে চাইছেন। পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ জানিয়েছে, কথা আসলে অনেক হয়েছে। কিন্তু সেগুলি এখন প্রকাশ্যে আনাটা ঠিক নয়। বিষয়গুলি সংবেদনশীল। তাই সেগুলি প্রকাশ্যে আনছেন না। আসলে সমস্যা হয়েছে, কাশ্মীর, সার ক্রিক, সিয়াচেন— এই প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও যেহেতু এটি আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নয়, সেহেতু দু’পক্ষই এটি প্রকাশ্যে আনছে না। ফলে দু’পক্ষকেই সমালোচনা সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কূটনীতিকরা মনে করছেন, এতে আস্থা বাড়বে।

২০১৪ সালের মে মাসে যখন নওয়াজ শরিফ ও নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক হয়েছিল, তখন শরিফ নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দু’দেশের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্তরে সন্ত্রাস নিয়ে বৈঠক করতে। তখন মোদী সরকার সেই প্রস্তাব মানেননি। বরং চেয়েছিল, টপ-ডাউন থেকে বটম-আপ অনেক বেশি ভাল। আগে নিচুস্তরে আলোচনা হোক, তার পর উপরমহলে হবে। কূটনৈতিক মহলের ধারণা, যে ভাবে চিন নানা ইস্যুতে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, সে দিক থেকেও মোদীকে এখন কিছুটা সুর নরম করতে হয়েছে। এই পথ-নির্দেশিকার ভিত্তিতেই বিদেশসচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তা হলে মোদী জমানায় ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতির প্রাসঙ্গিকতা কি কমছে?

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE