রায় ঘোষণার পর উল্লাস। ছবি: পিটিআই।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়ের পর আমার কিছু পুরনো কথা মনে পড়ল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এক বামপন্থী নেতা বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও সমকামী মানুষ থাকতে পারে না। তাঁদের মনে হয়েছিল, এইচআইভি পজিটিভটা যেমন নেগেটিভলি পজিটিভ, সমকামিতাও তেমনই সাম্যবাদের অন্তরায়। সেই নেতা ও তাঁরই মতো আরও অনেকের সেই বক্তব্য যে কত বড় ভুল ছিল, আজকের রায়দান সেই রায়বাহাদুরদের রক্ষণশীলতাকেই প্রমাণ করল।
আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছেকে মূল্য দেওয়া, এটাই সুপ্রিম কোর্টের বড় দায় ও বড় রায়। ব্রিটিশের করা আইনের থেকে যে আমরা ক্রমেই শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু করে মুক্ত হচ্ছি, এটাও আমাদের প্রতি দিনকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির নয়া স্বাদ। আমরা বাহ্যিক বা দৈহিক লিঙ্গের প্রেক্ষিতে যৌনতাকে বিচার করি বলে সমলিঙ্গের দু’জন মানুষের যৌনতাকে বলি সমকাম। দু’জন সমকামী মানুষ যখন মিলিত হন তখন কিন্তু তাঁদের মধ্যে এক জন নারী ও এক জন পুরুষ।
অন্ধকার-আলো, চন্দ্র-সূর্য যেমন একসঙ্গে সম্ভব নয়, তেমনই বৈপরীত্য থাকবে এটাও সত্য। তবে এই বৈপরীত্যকে শুধুমাত্র দৈহিক লিঙ্গের সীমাবদ্ধতায় বেঁধে রাখা উচিত ছিল না এত দিন ধরে। আমরা বোধহয় মনোবিজ্ঞানের দিক থেকেও অনেকটা এগিয়ে গেলাম। দেহের লিঙ্গই শেষ কথা নয়, মনেরও লিঙ্গ নির্ধারণ প্রয়োজন, যে হেতু এক জন দৈহিক, বাহ্যিক লিঙ্গে পুরুষ হয়েও মানসিক লিঙ্গে নারী হতে পারেন। আমি গাইতাম, ‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও আধা’।
আনন্দের আলিঙ্গন। ছবি: রয়টার্স।
সে ভাবেই আমরা একই ছাতার তলায় চলে এসেছিলাম সমকামিতা, রূপান্তরকামিতার নাম ধরে। কোথাও একটা প্রান্তিকতার দাগও দেগে দেওয়া হয়েছিল। আজ বুঝতে পারছি, প্রান্তবর্তী মানুষরাই বোধহয় সূর্যোদয় আগে দেখি। নিন্দুকেরা বলেন, এটা কোনও প্রগতি নয়, এটা আসলে প্রস্তুতি। মূল স্রোতের ভণ্ড মানুষরাও চর্যাপদের অন্ধকারে বিচরণ করেন, অবতরণ করেন যৌনতার সময় এই প্রান্তবর্তী মানুষদের আঙিনায়। দাসীর রোগ যাতে বাবুর শরীরে ধরা না পড়ে, গোটা সমাজটাকেই একটা কন্ডোমে মুড়ে ফেলাটা ভাল উপায়।
আরও পড়ুন
সমকামিতা অপরাধ নয়, ঐতিহাসিক রায় সুপ্রিম কোর্টের
এইচআইভি পজিটিভের কাছেও আমরা পজিটিভলি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারি। যে হেতু এইচআইভি না এলে এডস প্রতিরোধক সমাজসেবী সংস্থাগুলো তৈরি হত না। তারা না চাইলে ৩৭৭ ধারা নিয়ে আবেদনও জমা পড়ত না এবং তা জমা না পড়লে সুপ্রিম কোর্টেরও কোনও মাথাব্যথা থাকত না। সেই জন্য খরা, মহামারী, এরা যে ধ্বংসাত্মক হয়েও কোথাও কোথাও ইতিবাচক হয়ে ওঠে, চর্যাপদের বৌদ্ধতন্ত্রের ঈশ্বরলাভের মতো, এটাই আজকে আমার বৌদ্ধিক উপলব্ধি।
‘এইচআইভি পজিটিভের কাছেও আমরা পজিটিভলি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারি।’ ছবি: এএফপি।
পৃথিবীতে সবাই আমরা সব বিষয়ে সমানাধিকার চাই, কিন্তু সমকামটাই ছিল অন্যায়। যদিও জানি, কাম কখনও সমকাম হয় না। দীক্ষা যেমন এক জন দেন, এক জন গ্রহণ করেন, পৃথিবীর সব আনন্দে এক জন থাকেন দাতা, আর এক জন গ্রহীতা। যৌনতাও তো এক ব্যক্তিমানুষের জীবনের এক পর্যায়, আসল সম্পর্ক হল দু’টি মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতা। সেই নির্ভরতার একটা ইন্ধন হয়তো যৌনতা থেকে আসে। দু’টি ব্যক্তিমানুষের একান্ত পারস্পরিক ব্যক্তিগত নির্ভরতা সেই দু’টি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। সেই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সুরক্ষিত করার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য সুপ্রিম কোর্টের।
(লেখক কৃষ্ণনগর উইমেনস কলেজের অধ্যক্ষ। ভারতের প্রথম রূপান্তরিত অধ্যক্ষ তিনিই।)
(ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy