মুখে অবিরত হাসিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, গোটা রাতের মহড়া।
তা না হলে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় বিস্ফোরক রদবদলের পর গোটা নজরটি যখন শুধুমাত্র তাঁর দিকেই কেন্দ্রীভূত, তিনি কী করে এতটা অবিচল থাকতে পারেন?
আজ সকাল থেকেই গোটা সংবাদমাধ্যমের ভিড় ছিল কেন্দ্রের নতুন বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানির বাড়ির সামনে। সদ্য গতকাল রাতেই যাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে। তারপর থেকে নিজেকে ঘরবন্দিই রেখেছিলেন। প্রথম অতিথি নতুন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর। তিনি যেতেই সক্রিয় হলেন স্মৃতি। টুইটারে নিজের ছবি বদল করলেন। অপেক্ষাকৃত আরও তরুণ বয়সের। নিজের সম্পর্কে জানালেন, কেন্দ্রের বস্ত্রমন্ত্রী তিনিই। টুইটের পর্দায় একের পর এক শব্দগুচ্ছ ভেসে উঠল। প্রধানমন্ত্রী, প্রকাশ জাভড়েকর, মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের কর্মীদের ধন্যবাদ জানালেন একে একে। তার পরেই ছুটলেন নতুন মন্ত্রকের ভার নিতে।
আর সেখানেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বোঝালেন, দেশজুড়ে তাঁকে নিয়ে এত বিতর্ক কোনও কিছুই যেন দাগ কাটেনি। এক মুহূর্তের জন্য মুখের হাসি ম্লান হয়নি। যেন ‘কিউকি সাঁস ভি কভি বহু থি’র নিখুঁত চিত্রনাট্য পাঠ করছেন। আপনাকে নিয়ে এত বিতর্কের কারণেই কি মন্ত্রক বদল হল? উত্তরপ্রদেশে মুখ করার জন্যই কি আপনাকে অপেক্ষাকৃত লঘু মন্ত্রক দেওয়া হল? প্রশ্নবাণের মুখে হাস্যমুখে স্মৃতির জবাব, ‘‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কহনা। এই প্রথম বস্ত্র মন্ত্রকে এত বেশি সাংবাদিককুল, নিশ্চয়ই আপনাদের সমর্থন থাকবে। কৃষির পর বস্ত্র মন্ত্রকই সবথেকে বেশি রোজগার দেয়, আর প্রধানমন্ত্রী সেই দায়িত্বই আমাকে দিয়েছেন। আর গত দু’বছরের আলোচনার পর যে শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে, আমি খুশি, নতুন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সেই নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’’
এত দিন ধরে স্মৃতি ইরানির মন্ত্রকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগই উঠে এসেছে, আরএসএসের কথায় তিনি শিক্ষার গৈরিকীকরণ করেছেন। আজও কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনে একগুচ্ছ তালিকা পেশ করে জানিয়েছেন, কী করে শিক্ষার গৈরিকীকরণ হচ্ছে। সদ্য গতকাল ছত্তীসগঢ়ে ৬ জন উপাচার্যকে আরএসএস ডেকে পাঠিয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনার জন্য। মণীশ বলেন, ‘‘যে গতিতে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করার কথা ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব, সেটি তাঁকে দিয়ে হচ্ছে না বলেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে স্মৃতি ইরানিকে। তাই নতুন মন্ত্রীকে নিয়ে আসা হয়েছে।’’
বিজেপির শীর্ষ সূত্র বলছে, স্মৃতি ইরানির উপর সঙ্ঘ নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ ছিলেন এমন নয়। বরং সঙ্ঘের প্রিয়পাত্রই ছিলেন তিনি। সঙ্ঘের কথায় সংস্কৃত পাঠন থেকে বিভিন্ন নিয়োগ, সবই করছিলেন স্মৃতি। তবে স্মৃতিকে নিয়ে সমস্যা হল, এই কাজটি তিনি করছিলেন অনেক সশব্দে। অহেতুক এমন এমন বিতর্ক তিনি তৈরি করছিলেন, যাতে সরকারের ভাবমূর্তিও সরাসরি ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। স্মৃতির ঔদ্ধত্য, বিভিন্ন বিষয়ে আগ বাড়িয়ে বিতর্ক তৈরি করা— সব কিছুই তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে। বিদেশের পত্র-পত্রিকাতেও স্মৃতিকে ‘বিতর্ক রানি’ অ্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে তাঁকে সরানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। কারণ, সঙ্ঘ নেতৃত্ব মোদী-অমিত শাহকে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, কোনও এক ব্যক্তি তাঁদের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিষয়টি হল, তাঁদের আদর্শ রূপায়ণের জন্য কে ভাল ভাবে কাজ করতে পারছেন।
সঙ্ঘের এক নেতা আজ বলেন, ‘‘আরএসএস-এ আমরা শিখেছি, সব কাজই নিঃশব্দে করতে। স্মৃতি ইরানির সমস্যা হল, তিনি অনেক বেশি আওয়াজ করছিলেন। বাস্তবে যা কাজ হচ্ছিল, তার থেকে বেশি শব্দ হচ্ছিল।’’ সঙ্ঘের এই নেতার কথাতেই স্পষ্ট, স্মৃতি ইরানির বিদায়ের পিছনে প্রধানমন্ত্রীর বাধ্যবাধকতা কী ছিল। সে তুলনায় এখন যে প্রকাশ জাভড়েকরকে সেই মন্ত্রকে নিয়ে আসা হয়েছে, তিনি অনেক বেশি নিঃশব্দে কাজ করতে পারেন। অনেক বড় বিতর্কও হাসিমুখে সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে পারেন। আজ প্রথম দিনেই তিনি বলেন, স্মৃতি ইরানির জমানায় নেওয়া ‘ভাল পদক্ষেপ’গুলি তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই পর্যন্ত বললেও তার একটি অর্থ ছিল। কিন্তু আরও একধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, তাঁর মন্ত্রকের কাজ নিয়ে কথা বলবেন প্রাক্তন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী মুরলী মনোহর জোশীর সঙ্গে।
অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে মুরলী মনোহর জোশীই এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁকে শিক্ষার গৈরিকীকরণের কারিগর বলা হয়। নিজেরই দলের কোনও নেতার সঙ্গে দেখা করা বা পরামর্শ করার বিষয়টি কোনও বড় বিষয় নয়। যে কোনও সময় প্রকাশ জাভড়েকর সেই কাজটি অনায়াসে করতে পারেন। কিন্তু প্রথম দিনে সাংবাদিকদের কাছে জোশীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে জাভড়েকর স্পষ্ট বার্তা দিলেন সঙ্ঘ নেতৃত্বকে। বুঝিয়ে দিলেন, সঙ্ঘের গৈরিকীকরণের অ্যাজেন্ডা তিনি সঠিক ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যদিও স্মৃতি জমানায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে বিতর্ককে সামাল দিতে জাভড়েকর বলেছেন, তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। ফলে তিনি সকলের সঙ্গে আলোচনা করবেন। যাতে কোনও আন্দোলনের অবকাশ না থাকে। শিক্ষা দলগত রাজনীতির বিষয় নয়।
স্মৃতি বিদায়ের পর সঙ্ঘ নেতৃত্ব আপাতত একটি বিষয়ে আশ্বস্ত, জাভড়েকর তাঁর স্বভাবের মতোই নীরবে কাজ করতে পারবেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি যুক্ত এবিভিপি-র সঙ্গে। মহারাষ্ট্রের এই নেতাকে আরএসএসের ঘনিষ্ঠ বলেই মানা হয়। জরুরি অবস্থার সময় কারাবাসও করেছেন। জাভড়েকরের বাবা কেশবকৃষ্ণ জাভড়েকর হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী দামোদর সাভরকরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর বাবা। সেই পরিবেশেই বড় হয়েছেন তিনি। সঙ্ঘ সূত্রের মতে, এনসিআরটি বইয়ের পর্যালোচনা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির পুনর্গঠন, শিক্ষায় মাতৃভাষা প্রয়োগের মতো সঙ্ঘের অনেকগুলি বিষয় এখনও বকেয়া রয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতেও এর অনেকগুলির প্রভাব রয়েছে। সঙ্ঘের আশা, এই বিষয়গুলি এখন নতুন শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়ে রূপায়ণ হবে। সশব্দে নয়, নিঃশব্দে।
আরও খবর...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy