Advertisement
০৩ মে ২০২৪

জয়ের ব্যবধান নিয়েই ভাবছে বারাণসী

গোটা দেশকে কিছুটা চমকে দিতে চেয়ে যখন নয়াদিল্লিতে এই প্রথম কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তখন তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসীতে প্রচারের শেষ পর্বে বারবার ঘুরে ফিরে এই ‘বিশ্বরেকর্ডে’র কথাটি উঠে আসতে দেখছি গেরুয়া শিবিরে।

ভক্ত: ভোটের আগে বারাণসীতে। নিজস্ব চিত্র

ভক্ত: ভোটের আগে বারাণসীতে। নিজস্ব চিত্র

অগ্নি রায়
বারাণসী শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০১:৩৪
Share: Save:

দশাশ্বমেধের ঘাটে দু’দণ্ড দাঁড়ালে মেজাজ অপ্রসন্ন হয়ে যাচ্ছে, এমনই দূষিত গঙ্গার হাল।

কিন্তু দেবস্থান এমনিতেই পবিত্র! তার বাছবিচার চলে না।

আপাতত মন দিন বিশ্বরেকর্ডে।

৬০০ কোটি টাকার ‘বিশ্বনাথ করিডরের’ ঠেলায় উদ্বাস্তু হয়েছেন প্রায় তেরো হাজার মানুষ।

তা হোন। দেব-পর্যটনে স্বপ্নের মিশেল দিতে গেলে এমনটা তো হতেই পারে।

বরং জোর দেওয়া হোক বিশ্বরেকর্ডে।

গত পাঁচ বছরে কোনও শিল্প আসেনি বারাণসীতে। তা না আসুক। বার্তা দেওয়া হোক বিশ্বরেকর্ডের।

গোটা দেশকে কিছুটা চমকে দিতে চেয়ে যখন নয়াদিল্লিতে এই প্রথম কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তখন তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসীতে প্রচারের শেষ পর্বে বারবার ঘুরে ফিরে এই ‘বিশ্বরেকর্ডে’র কথাটি উঠে আসতে দেখছি গেরুয়া শিবিরে। অর্থাৎ এখানে মোদীর জয়টা বড় কথা নয়। কথা হল, মোদীকে এমন ভাবে জেতাতে হবে এখানে, যে সংখ্যাটি আগে কখনও কেউ পাননি। এই বার্তা দেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও দিতে হবে যে, নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা বারাণসীর ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রায় সমানুপাতিক!

‘মহাদেব কি মায়া হ্যায়, মোদী ঘর ঘর ছায়া হ্যায়!’ ‘কাশি মাঙ্গে বার বার, নরেন্দ্র মোদী বার বার।’ ‘হর হর মহাদেও।’ বারাণসীর ব্যস্ত মাহমুরগঞ্জ এলাকা গমগম করছে এই স্লোগানে। মোদী-সাজে সুসজ্জিত নকল-নরেন্দ্র মোদীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাতে গদার মতো সুবিশাল পদ্মের কাটআউট নিয়ে! আসল নরেন্দ্র মোদী এসেছিলেন সেই মনোনয়ন পত্র জমার দিনে। ওই দিন রোড-শোও করেছিলেন। তার পর থেকে নিজের কেন্দ্রে আর আসেননি। জল্পনা ছিল, প্রচারের শেষ দিনে একেবারে শেষ লগ্নে হয়তো আসবেন মোদী। কিন্তু তা হয়নি। এখানেই অতিকায় ভবন ‘তুলসি উদ্যান’, যা আপাতত মোদীকে সাড়ে ছ’লাখ ভোটে জেতানোর (গত বারে যা ছিল পৌনে তিন লাখ) ওয়ার রুম হিসাবে কাজ করছে। ‘‘আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার শেষ হয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু মানুষের বাড়ি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে, সামাজিকতা করতে তো কোনও বাধা নেই।’’ অকপটে জানাচ্ছেন উমেশ শুক্ল। এখানকার প্রদেশ বিজেপির প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। যিনি বলছেন, ‘‘সংখ্যা বাড়ানোটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উপর থেকে এমন নির্দেশই দেওয়া হয়েছে আমাদের।’’

কথা বলে জানা গেল, প্রত্যেক তিরিশ জন ভোটারের জন্য একজন করে বিজেপি কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ওই তিরিশ জনের ঠিকুজি, গতিবিধি সব সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নখদর্পণে। ‘অন্য দিকে’ যাতে ভোটারের মন না যায়, সেটিও কড়া নজরে রাখার কথা। রাখা হচ্ছেও। প্রতিদিন প্রত্যেকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তার ফিডব্যাক জমা পড়ছে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সিস্টেমের কাছে। মোট বুথের সংখ্যা এখানে ১৮১৯টি। সাত-আটটি করে বুথকে একজোট করে একটি করে সেক্টর করা হয়েছে। প্রত্যেক সেক্টরের জন্য রয়েছেন একজন করে কো-অর্ডিনেটর। জনসভার থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের ‘বিকাশ’ বোঝানোয়। পরিকাঠামো, উজালা ভারত, স্বচ্ছ ভারত-সহ মোদীর বিভিন্ন প্রকল্পের গুণাগুণ তুলে ধরার।

১৮৭০ সালে তৈরি শ্রীরাম ভাণ্ডার কয়েক শতাব্দী ধরে কাশীর মানুষকে খাবার জোগাচ্ছে। আজও এখানে প্রতি ভোরে লাইন পড়ে গরম গরম পুরি সব্জির জন্য। দু’হাতে ব্যবসা সামলাতে সামলাতে মদনমোহন পাণ্ডে বলছেন, ‘‘গোটা উত্তরপ্রদেশের ছবিটা তো এখানে দেখতে পাবেন না। এখানে প্রিয়ঙ্কা রোড-শো করে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে বিরোধী জোটের মুসলমান ভোট ভাগ ছাড়া কিছু বিশেষ হয়নি। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের অন্যত্র এসপি-বিএসপি জোট ভাল লড়াই দিলেও এখানে প্রশ্নটা মোদী জিতবেন কি না, নয়। প্রশ্ন হল, কত বড় ব্যবধানে জিতবেন।’’

১৯৯১ সাল থেকে বারাণসী টানা বিজেপির দখলে। মাঝে পাঁচ বছরের জন্য ছেদ পড়েছিল ২০০৪ সালে। ২০০৯ থেকে আবার গেরুয়া দুর্গ। অথচ আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের হৃদয়ে থাকা বিশ্বের এই সুপ্রাচীন জনপদটিও
উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য এলাকার মতো জাতপাতের অঙ্কে বিভক্ত। রয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ মুসলিম। কিন্তু গত কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আরএসএস যেটা সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছে তা হল, যাদব-পটেল-বৈশ্য এমনকি দলিতদেরও হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসা। কর্মসংস্থান হোক না হোক, বছরভর নুক্কড় নাটক, বাছাই করা মঠ মন্দিরের পরিচর্যা, হিন্দু সংস্কৃতির রাজধানী হিসাবে কাশীকে তুলে ধরার কর্মসূচিতে কোনও গাফিলতি করেনি বিজেপি-আরএসএস।

গাফিলতি করছে না মোদী নিজেও। শেষবেলার প্রচারে না এলেও বারাণসীর ভোট-মঞ্চে রবিবার বিকেল পর্যন্ত নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার অঙ্ক তিনি কষে ফেলেছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। শনিবার তিনি যাবেন কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ দর্শনে। একটি সূত্রের দাবি, শিবতীর্থ কেদারনাথে মোদীর ভক্তির প্রচার সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হবে আর এক শিবতীর্থ বারাণসীতে। অঙ্ক বুঝে চুপ করে নেই কংগ্রেসও। তারা কিছুটা কটাক্ষের সুরেই বলেছে, রাহুল গাঁধী পায়ে হেঁটে কেদারনাথ ধামে গিয়েছিলেন। এটা খুবই ভাল যে, সেই পথ ধরেই মোদীও কেদারনাথে যাচ্ছেন। তবে তাঁর উচিত, রাহুলের মতোই পায়ে হেঁটে কেদারে যাওয়া।

তবে এ সব নিয়ে ভাবছেনই না এখানকার বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের মন্ত্র একটাই— বিশ্বরেকর্ড।বিশ্বরেকর্ডের সেই প্রচারই কার্যত ভোটের প্রচার হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্রে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 BJP Vote Lead Varanasi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE