ছবি: এএফপি।
নিছক কাকতালীয়। তবু দশাশ্বমেধ রোড ধরে হাঁটতে গিয়ে চোখ আটকে গেল বাতিস্তম্ভে।
নরেন্দ্র মোদীর সামান্য ঝুঁকে যাওয়া আবক্ষ কাটআউট। শুধু পড়া যাচ্ছে ‘ফির মোদী’। তার নীচে বাতিস্তম্ভে লেখা— ‘ডেঞ্জার, ৪৪০ ভোল্ট’। তারও নীচে সুখ-দুঃখের কথা বলছেন তিন খেটে খাওয়া মানুষ। মোদীর ‘মেগা রোড-শো’র পর বারাণসীতে চক্কর কেটে মনে হল, এই কেন্দ্রের এটাই ছবি।
একে প্রধানমন্ত্রী, তাতে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’। তাঁকে লোকসভায় ফেরাতে সম্ভবত খুব বেশি চিন্তা করছে না বারাণসী। অনেকেই বলছেন, মোদীর জমানায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি হয়েছে। রান্নার গ্যাস এসেছে। বলছেন শৌচাগার, রাস্তা চওড়া ও এলাকা পরিষ্কার হওয়ার কথা। মেনে নিচ্ছেন, গত বার তবু অরবিন্দ কেজরীবাল ছিলেন। এবার কেজরী নেই। কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী অজয় রাই সেই তুলনায় নস্যি। গত বার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর। একেবারে শেষ বেলায় আগে ঘোষিত প্রার্থী শালিনী যাদবের নাম বদলে তেজ বাহাদুর যাদবকে প্রার্থী করেছে এসপি-বিএসপি জোট। সেনাবাহিনীতে খাবারের খারাপ মান নিয়ে মুখ খুলে সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া এই জওয়ানকে বিজেপির দেশভক্তির প্রচারের পাল্টা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে তারা। যাকে সে ভাবে আমলই দিচ্ছেন না স্থানীয় বিজেপি নেতারা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কোথাও ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আছে। অনেক দিন ধরেই রাজসূয় যজ্ঞ চলছে বিশ্বনাথ মন্দিরের গা ঘেঁষে। ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ের পাতায় দেখা হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর মতো হয়ে রয়েছে লাগোয়া বিস্তীর্ণ অংশ। চার দিকে ভাঙা বাড়ি, দোকান আর মন্দির। ৬০০ কোটি টাকা লগ্নিতে তৈরি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘বিশ্বনাথ করিডর’। সেখানে বড় বড় দোকান বসবে। দর্শনের টিকিট থেকে প্রসাদ— সব মিলবে এসির ঠান্ডায়। বান আসবে পর্যটনে। শুনেই ফুঁসে উঠলেন কৃষ্ণ কুমার শর্মা। তাঁর ও রাকেশ যাদবের দাবি, ‘‘আমাদের তল্লাটে সরকারি ভাবে ১৬০-১৭০টি বাড়ি ভাঙার কথা বলা হলেও গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রায় ৩০০টি। যার মধ্যে ২৩০-২৫০টিই দোকান। ফুল, মালা, পূজার সামগ্রী, প্রসাদ ইত্যাদির। আতান্তরে প্রায় ১০-১৫ হাজার মানুষ।’’ তাঁদের দাবি, এই এলাকা বরাবর বিজেপির গড়। কিন্তু এ বার লজ্জায় ভোট চাইতে আসেননি স্থানীয় নেতারা। কিন্তু নতুন করে কিছু গড়তে গেলে পুরনো জিনিস ভাঙতে তো হবেই? কাগজ ছাড়া জমি দখল করে রাখার কথাও তো বলছে প্রশাসন।
ভোটপ্রার্থী: বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর কাটআউট। নিজস্ব চিত্র
কানহাইয়া যাদব, মনোজ শর্মা, জ্যোতিপ্রকাশ শর্মাদের অভিযোগ, উন্নয়নে আপত্তি নেই। কিন্তু তা করতে গিয়ে যাঁদের পেটে টান পড়বে, তাঁদের সঙ্গে এক বার কথা পর্যন্ত বলেনি প্রশাসন। লিখিত নোটিস দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ঠিক করা হচ্ছে মর্জিমাফিক। যাঁরা স্বেচ্ছায় বাড়ি বা দোকান ছাড়তে চাননি, তাঁদের কারও বিদ্যুতের বিল সামান্য ক’টা টাকা বাকি পড়লেই সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে, কারও দোকানে হানা দিয়েছে আয়কর দফতর।
বিক্ষুব্ধদের বক্তব্য, এই প্রকল্প গড়তে গিয়ে কাশীর সংস্কৃতিতেই কুড়ুল মেরেছেন মোদী। আগে অস্সি ঘাট থেকে গলিপথ হয়ে সোজা রাজঘাট পর্যন্ত যাওয়া যেত। করিডরে তা বন্ধ হবে। হারিয়ে যাবে মন্দির এলাকার বিখ্যাত ‘গলিমার্গ’। ক্ষতিপূরণের টাকা যেটুকু মিলবে, পরিবারে ভাগ-বাঁটোয়ারার পরে তা আর চোখে দেখা যাবে না। প্রকল্প নিয়ে সরকার যে ভাবে বয়ান বদলেছে, তা-ও ঘি ঢেলেছে ক্ষোভের আগুনে। স্থানীয়েরা বলছিলেন, ‘‘প্রথমে বলা হল, কোনও বাড়ি ভাঙা হবে না। শুধু চওড়া হবে রাস্তা। তারপরে শুনলাম, মন্দির থেকে সরাসরি যাতে গঙ্গা দর্শন করা যায়, সে কারণেই এই উদ্যোগ। কিন্তু ২৪০ মিটার দূর আর ১৮০ ফুট নীচে থাকা গঙ্গাদর্শন নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই বলা হল, এই সমস্ত বাড়ি আসলে মন্দিরের জমির জবরদখল।’’ অথচ এক সময়ে মুঘল আক্রমণ থেকে মন্দিরকে রক্ষা করতেই তাকে চার দিক ঘিরে এ ভাবে বাড়ি তৈরি হয়েছিল বলে তাঁদের দাবি। সঙ্গে প্রশ্ন, জবরদখল হলে কেউ ক্ষতিপূরণ দেয় কি? কারও কটাক্ষ, ‘‘নিজেকে চা-ওয়ালা বলে দাবি করা প্রধানমন্ত্রী এখানে তিন গরিবের চায়ের দোকান অক্লেশে ভাঙলেন কী ভাবে? নাকি এখন চৌকিদার বলে সেই পরিচয় বেমালুম ভুলে গিয়েছেন তিনি?’’
ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা সঞ্জয় যাদব বলছিলেন, ‘‘মোদী কথা দিয়েছিলেন, বারাণসীকে কিয়োটো (জাপানের মন্দির নগরী) বানাবেন। এই তার নমুনা?’’ কেউ বলছেন, ‘‘এখানে হর হর মহাদেব বলে সভা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ বুলডোজারে গুঁড়িয়ে যাওয়া কত মন্দিরে বিনা ফুল-বেলপাতায় পড়ে আছে শিবলিঙ্গ।’’
ক্ষোভের চোরা স্রোত বারাণসী শহর থেকে সামান্য দূরের ভরখরা গ্রামসভাতেও। চাষি মনোজ সিংহ, মহেন্দ্র মিশ্র, বিজয় যাদব, প্রভু পটেলরা বলছিলেন, ‘‘হিমঘর নেই। জলের দরে ফসল ও আনাজ বেচতে হয়। তার উপরে গরু বিক্রিতে নিষেধে পাগল হওয়ার জোগাড়। হয় তা রাতে খেতের ফসল খেয়ে যায়, নইলে নিজে না খেয়ে তাকে জোগাতে হয় বিচুলি।’’
এ নিয়ে মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন জাভেদ খান, মহম্মদ সইদ, ওয়াসিম আহমেদরা। তাঁদের কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে মোদীর নামে অভিযোগ নেই। কিন্তু এখন সরকারি কাগজ হাতে নিয়েও গরু এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যেতে ভয় হয়।’’
প্রমোদ সিংহ, মহেন্দ্র প্রতাপ সিংহ, রমেশ সিংহরা বলেন, ‘‘আগে দিনে ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকাই মস্ত ব্যাপার ছিল। এখন কারেন্ট যায় না বললেই চলে। ভাল হয়েছে রাস্তাঘাটও। কিন্তু রোজগারের বন্দোবস্ত হল কোথায়? কোনও শিল্প আসেনি বারাণসীতে। যাতে ভর করে শহরে অধিকাংশ মানুষের পেট চলে, সেই পর্যটনের পরিকাঠামো আগের মতো।’’
জনতাই বলছে, এই কেন্দ্রের পাঁচ বিধানসভার তিনটিতেই তাঁরা বিজেপি বিধায়কের উপরে ক্ষুব্ধ। সেখানে কংগ্রেসের অজয় রাই বরং ঘরের লোক। পাঁচ বারের বিধায়ক। বিশ্বনাথ করিডর নিয়ে বিরোধিতার মুখও এখন এই নেতা। গত বার ভোটে এ কে-৪৭ রাখার অভিযোগ যতই তাঁর বিরুদ্ধে উঠুক না কেন।
কিন্তু...
এই কিন্তুটাই সম্ভবত আসল ভোটের বারাণসীতে। কারণ, মোদীর ভোট গত বারের ৫ লক্ষ ৮১ হাজারের থেকে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিছু কাজ, হিন্দুত্বের মুখ, নামের ওজন, বিশ্বস্ত ভোট মেশিনারি— এ সব তো আছেই। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে মোদী বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে, ইন্দিরা জমানার কমলাপতি ত্রিপাঠীর পরে বারাণসীর জন্য এত কেউ করেননি। বোঝাতে পেরেছেন, প্রথম পাঁচ বছর শুধু ট্রেলার ছিল। উন্নয়নের আসল সিনেমা এখনও বাকি। সেই বিশ্বাসে বুঁদ জনতাও।
আচ্ছা, সুকুমার রায় ‘খুড়োর কল’ লেখার আগের রাতে কি অচ্ছে দিনের স্বপ্নই দেখেছিলেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy