Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

ক্ষীর রাঁধবেন উপেন্দ্র নাকি ছানা কাটবে?

এ বার রোহতাস জেলার বিক্রমগঞ্জে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও একই গুজব—‘পূর্ব চম্পারণ আসন বিক্রি হয়ে গিয়েছে ১৫ কোটিতে’।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

দেবব্রত ঠাকুর
কারাকাট শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

এই গুঞ্জন পটনা থেকেই শুনে আসছি। ‘১৫ কোটির বিনিময়ে লোকসভা আসন বিক্রি’-র গল্প।

এ বার রোহতাস জেলার বিক্রমগঞ্জে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও একই গুজব—‘পূর্ব চম্পারণ আসন বিক্রি হয়ে গিয়েছে ১৫ কোটিতে’।

পটনায় বিজেপির সদর দফতরে বসে কথা হচ্ছিল দেবেশ কুমারের সঙ্গে। তখনও বিহারে মহাজোটের সব আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়নি। প্রদেশ সহ-সভাপতি দেবেশ কয়েক বছর আগেও পেশাদার সাংবাদিকই ছিলেন। তিনিই বললেন, পূর্ব চম্পারণে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতা অখিলেশ সিংহের ছেলে টিকিট পাচ্ছেন বলে শুনছি। কিন্তু মহাজোট তো ওই আসন ছেড়েছে উপেন্দ্র কুশওয়াহার রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টিকে (আরএলএসপি)! হাসলেন দেবেশ। বেরনোর মুখেই প্রায় ধাক্কা রাধামোহন সিংহের সঙ্গে। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন। পরিচয় দিতেই বললেন, ‘‘আপনারাই তো লিখেছিলেন, আমি মনোনয়ন পাব না!’’ দেবেশকে নিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন নিখাদ সঙ্ঘী রাধামোহন। দলেরই আর এক নেতৃস্থানীয় ফিসফিস করে বললেন, ‘‘অখিলেশের ছেলের ব্যাপারটা নিয়ে মন্ত্রীজি একটু চিন্তিত। ১৫ কোটিতে আরএলএসপি সিটটা ভূমিহার অখিলেশকে বিক্রি করে দিয়েছে শুনলাম।’’ বোঝা গেল, শোনা কথাই মুখে মুখে ‘সত্য’ হয়ে উঠেছে।তার দিন সাতেকের মধ্যে আরএলএসপি প্রধান উপেন্দ্র কুশওয়াহা তাঁর ভাগের আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করলেন। জানালেন, নিজের পুরনো আসন কারাকাট ছাড়াও তিনি লড়বেন উজিয়ারপুর থেকে। এবং পূর্ব চম্পারণ থেকে দলের প্রার্থী কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ তথা ভূমিহার নেতা অখিলেশ সিংহের ছেলে আকাশ। সাংবাদিকদের প্রশ্নে জর্জরিত কুশওয়াহা দাবি করেন, আকাশ দীর্ঘ দিন ধরেই তাঁর দলের ‘ডেডিকেটেড’ সদস্য। সে কথা শুনে সাংবাদিক সম্মেলনে চাপা হাসির রোল উঠেছিল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দক্ষিণ বিহারের কারাকাট আসলে ছোট্ট জনপদ। কাছাকাছি বড় গঞ্জ-শহর বিক্রমগঞ্জ। এর ছ’টি বিধানসভা আসনই রোহতাস জেলার মধ্যে। ভোট গণনা হয় জেলা সদর সাসারামে। ২০০৮ সালের ‘ডিলিমিটেশন’ প্রক্রিয়ায় জন্ম কারাকাটের। ২০১৪ সালের মোদী ঝড়ে বিজেপি-র শরিক দল হিসেবে এখান থেকেই জয়ী হন অনগ্রসর কুশওয়াহা-কোয়েরি সম্প্রদায়ের নেতা উপেন্দ্র। প্রথমবার জিতেই মোদী সরকারে প্রতিমন্ত্রীর পদ। সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে নীতীশ কুমার বিজেপির সঙ্গে ফের গাঁটছড়া বাঁধার পর থেকে সমস্যার শুরু। একদা নীতীশের ঘনিষ্ঠ উপেন্দ্রের গুরুত্ব রাতারাতি বিজেপি নেতৃত্বের কাছে কমে যায়। মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আরজেডি-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধেন তিনি।

বিহার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক কালে ‘ক্ষীর রাজনীতির’ জনক উপেন্দ্র ঘোষণা করেন, আরজেডির ভোট ব্যাঙ্ক, ‘গোপালক’ যাদব সম্প্রদায়ের ‘দুধ’ এবং কৃষিজীবী কুশওয়াহা-কোয়েরিদের উৎপাদিত ‘চাল’ দিয়ে বিহারে তাঁরা ‘ক্ষীর’ (পায়েস) রাজনীতির জন্ম দেবেন।

বিক্রমগঞ্জে প্রকাশ কুমারের ওষুধের দোকানে রাজেশ্বর সিংহের সঙ্গে আলাপ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দুধ আর চাল মিলিয়ে পায়েস হয় ঠিকই। কিন্তু আসল কৃতিত্ব তো রাঁধুনির। তা না হলে তো দুধ-ভাতই রয়ে যায়। ক্ষীর হয় না।’’ রাজপুত রাজেশ্বর সিংহ জয়প্রকাশ আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। দাবি, তিনি রামমনোহর লোহিয়া-বাদী। তাঁর কথায়, রাজপুত প্রধান (২০ শতাংশেরও বেশি) কারাকাটে এ বার বর্তমান সাংসদের পায়ের তলার জমি নেই। সে কারণেই দ্বিতীয় আসন থেকেও লড়ার কথা ভেবেছেন। রাজেশ্ববাবুর সঙ্গে গলা মেলালেন, ওষুধ-ব্যবসায়ী প্রকাশ কুমারও, ‘‘আরে নিজের ভাগের সিট বেচে দিচ্ছেন ভূমিহারের কাছে। ওকে হারানো তো আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’’ ইনিও রাজপুত। ঘাড় নাড়লেন পাশে বসা আরও এক বৃদ্ধ, রামলক্ষ্মণ পাণ্ডে।

যদিও স্থানীয় কুশওয়াহা সমাজের এক নেতৃস্থানীয়ের বক্তব্য, কারাকাটে জেডিইউ প্রার্থী তথা প্রাক্তন সাংসদ মহাবলী সিংহ ও উজিয়ারপুরে বিজেপি রাজ্য সভাপতি নিত্যানন্দ রায়ের বিরুদ্ধে লড়তে নেমে একই সঙ্গে নীতীশ কুমার ও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে বার্তাই দিতে চেয়েছেন উপেন্দ্রবাবু। এবং দু’টি জায়গাতেই তিনি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জিতবেন। বিহারে ‘ক্ষীর রাজনীতি’ নতুন চেহারা নেবে। উল্লেখ্য, কারাকাটে কুশওয়াহা-কোয়েরি ভোট ৮ শতাংশেরও বেশি। যাদব ভোটের পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ। রয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ মুসলিম ভোট।

তবে এই জাতপাতের অঙ্ক মানতে নারাজ কারাকাটের রামজি যাদব। তরুণ রামজি চা-মিষ্টির দোকানে দোকানে ছানা-দুধ সরবরাহ করেন। ক্ষীর হবে এই দুধে? দোকানির দিকে তাকালেন রামজি, দু’জনেই হেসে উঠলেন, ছানা কেটে যাবে।

কারাকাট নীতীশ কুমারের কাছে গয়ার মতোই ‘প্রেস্টিজ সিট’। গয়ায় যে ভাবে একদা ঘনিষ্ঠ মহাজোট প্রার্থী জিতনরাম মাঁঝিকে হারানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি, এখানেও উপেন্দ্র কুশওয়াহাকে হারাতে তিনি মরিয়া। প্রচারে এসে বলেই গিয়েছেন, মহাবলীবাবুর লড়াই তাঁরই লড়াই। ২০১৪-র মোদী-ঝড়ে বিধ্বস্ত নীতীশের পাশে এ বার সেই ‘দাবাং’ নরেন্দ্র মোদীই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE