অমিত শাহ ও যোগী আদিত্যনাথ। গোরক্ষপুরে। নিজস্ব চিত্র
মুখে প্রায় সারাক্ষণ ঠেসে রাখা জর্দা আর পানমশলায় ক্ষয়ে গিয়েছে দাঁত। ক্রমাগত ঘাম মুছছেন গলায় ঝোলানো কাপড়ে। দাঁড়িয়ে হোটেলের লবিতে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের অপেক্ষায়। তারই মধ্যে নাকের উপরে নেমে আসা চশমা ফের ঠেলে তুলে দিতে দিতে স্থানীয় বিজেপি নেতা চুপিসারে বললেন, ‘‘গোরক্ষপুরে কী হবে জানতে চান তো? উত্তর যোগীজির সুটকেসে!’’
যোগী আদিত্যনাথ। তাঁর কমবেশি প্রভাব পূর্বাঞ্চলের ১৩টি আসনেই। কিন্তু গোরক্ষপুর যেন তাঁর বাড়ির উঠোন। যেখানে নিজের দলের কাউকে খেলতে দিতেও নাকি তাঁর বড্ড আপত্তি।
আর এই আপত্তির কারণেই খেলা জমে গিয়েছে গোরক্ষপুরে। ১৯৮৯-৯০ সালে কংগ্রেসের হাত থেকে এই আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল হিন্দু মহাসভা। তার পর থেকে বিজেপি। ১৯৯৮ সালে এই আসনে জিতে আদিত্যনাথ যখন প্রথম সংসদে পা রাখেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬। সেই থেকে ২০১৭ পর্যন্ত টানা পাঁচ বার এখানে বিজেপি সাংসদ তিনি। খেলা তো একপেশে হওয়ার কথা! তাহলে?
অমিত শাহের কনভয়ের অপেক্ষায় হোটেলের বাইরে খৈনি ডলছেন পুলিশকর্মী। জিজ্ঞাসা করলাম, কত ভোটে জিতবে বিজেপি? এ পাশ-ও পাশ দেখে উত্তর দিলেন, আগে দলের কর্মীদের জিজ্ঞাসা করুন, ঘরে ভাল লোক থাকতে মুম্বই থেকে ভোজপুরী ছবির নায়ক রবি কিষণকে প্রার্থী করতে হল কেন? কেনই বা হারতে হল ২০১৮-র উপনির্বাচনে?
‘ফির এক বার, মোদী সরকার’— হোটেলের বাইরে গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান তুলছেন বিজেপি সমর্থকেরা। হাওয়া কেমন জিজ্ঞাসা করতেই পাখিপড়ার মতো উত্তর এল, বালাকোট-গ্যাস সিলিন্ডার-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ-প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা- এবং আরও অনেক কিছু। অর্থাৎ, জয় প্রায় মুঠোয়। তা হলে গতবার
হারলেন কেন?
মুহূর্তে পাতলা হয়ে গেল ভিড়। তবু দেবেশ সিংহ, বিজয় পাসোয়ান, রাজনাথ যাদব, বিজয় মৌর্যদের জটলা দাবি করল, ‘‘গত ভোটকে খুব আলগা ভাবে নিয়েছিল দল, জনতাও। আসলে উপনির্বাচন তো। ভোটই পড়েছিল অনেক কম। বিশেষত শহর ও মফস্সলে। তার উপরে যোগীজি ছিলেন না। তাই ওই হার।’’
কিন্তু আসল কথা বেরিয়ে আসছে একের সঙ্গে এক কথা বললেই। বিজেপি সমর্থকরাই বলছেন, ‘‘যোগীজি দেখাতে চেয়েছিলেন এখানে তিনিই বিজেপি। তাই স্থানীয় অন্য কেউ ভোট-যুদ্ধে জিতুক, গোরক্ষনাথের মঠাধ্যক্ষ তা চাননি। এ বারেও বিস্তর টালবাহানা শেষে বাইরের প্রার্থী কিছুটা সেই কারণেই।’’
এমনিতে বিজেপির সঙ্গে যোগীর সম্পর্ক যে বরাবরই অম্লমধুর, গুগল সার্চের খান কয়েক পেজে চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট। নইলে যে আদিত্যনাথ ও তাঁর মঠের নাম বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে জড়িয়ে, তিনিই কি না লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিলে হুইপ মানতে রাজি হননি। কখনও হুমকি দিয়েছেন পূর্ব উত্তরপ্রদেশে ৭০টি বিধানসভা আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার, তো কখনও তীব্র সমালোচনা করেছেন দলের। কট্টর হিন্দুত্বের লাইন থেকে সরে যাওয়ার কারণে। কিন্তু স্থানীয় বিজেপি সমর্থকরা যে সমস্ত গল্প শোনালেন, তার তুলনায়
গুগলও নস্যি।
নীরজ সিংহ বলছিলেন, ২০১৪ সালে সরকার গড়ার সময়ে দিল্লিতে মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেতে সুটকেস গুছিয়ে তৈরি ছিলেন যোগী। ডাক আসেনি। এরপরে ২০১৭ সালের মার্চে তাঁকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েও নাকি শেষ মুহূর্তে হিমাচল প্রদেশে সভা করতে চলে যান অমিত শাহ। ক্ষুব্ধ যোগী যখন গোরক্ষপুরে ফিরছেন, তখনই ফোন আসে তাঁর কাছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিতে লখনউ যাওয়ার জন্য। মানভঞ্জনের সেই পালায় নাকি ‘দু’কলি গাইতে হয়েছিল’ আরএসএসকেও।
কিন্তু এ বার তো যোগী বারবার প্রচারে গোরক্ষপুর আসছেন। কানের কাছে হিসহিসিয়ে এক বিজেপি নেতা বলে গেলেন, ‘‘করছেন কী সাধে। অমিত শাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, হয় নিজে লড়ুন নইলে দলের প্রার্থীকে জেতান। দু’টোর কোনওটাই না হলে, ইস্তফাপত্র তৈরি রাখুন!’’
রমেশ যাদব, লালন যাদব, উমেশ পাসোয়ানের মতো এসপি সমর্থক বলছেন, বিজেপি টের পাচ্ছে যে, এই কেন্দ্র জেতা বেশ কঠিন হবে তাদের পক্ষে। কারণ, এখানে ১৯.৬ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৯ লক্ষই পিছিয়ে পড়া জাতি, উপজাতির। যেমন, ৩.৫ লক্ষ নিষাদ, ২.২ লক্ষ যাদব, ২ লক্ষ দলিত আর ২ লক্ষ মুসলিম। এই ভোটের বেশির ভাগটাই যাবে এসপি-বিএসপি জোটের প্রার্থী রাম ভুয়ল নিষাদের পকেটে। বিশেষত ২০১৫ থেকে সংগঠন শুরু করা নিষাদরাও ২০১৭ থেকে এককাট্টা হয়ে ভোট দিতে শুরু করায় তা গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রে।
তার উপরে রয়েছে ব্রাহ্মণ বনাম ক্ষত্রিয়ের চোরা লড়াই। কয়েক দশক ধরে গোরক্ষপুরে ক্ষত্রিয়রা গোরক্ষনাথ মঠের ছাতার তলায়। আর ব্রাহ্মণরা অভাব-অভিযোগ জানাতেন মাফিয়া হিসেবে কুখ্যাত, এক সময়ে জেল থেকে বিধানসভায় জেতা নেতা হরি শঙ্কর তিওয়ারি ও তাঁর অনুগামীদের কাছে। এখন উত্তরপ্রদেশের পূর্বে প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা চলে আসায় সেই ব্রাহ্মণ ভোটও কিছুটা ভাগ হওয়ার কথা। নেতারা জানালেন, পরিস্থিতি বেগতিক বুঝেই আসছেন অমিত শাহ। বুথ ধরে ধরে সকলকে লক্ষ্য
বেঁধে দিতে।
এমন আসনে যোগী হেলায় জিততেন কী ভাবে? অল্পেশ ঠাকুর বলছেন, ‘‘গোরক্ষপুরের জন্য সব সময় লড়েছেন যোগীজি। কখনও এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে সরকারের টনক নড়াতে রাস্তায় বসেছেন। কখনও লড়ে গিয়েছেন চাষিদের দাবি, এমস আনা নিয়ে। হয়তো তাই বাবরি মসজিদ ভাঙা কিংবা গোষ্ঠী সংঘর্ষে হাত থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ভোট দিয়েছেন মঠের পিছনের মুসলিম মহল্লার অনেকে।’’
তার মানে তো যোগী রবি কিষণকে ভোট দিতে বললেই কেল্লা ফতে? ইস্, রাজনীতি যদি অত সহজ হত।
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার মরচে ধরিয়েছে তাঁর ভাবমূর্তিতে। এক যোগী অনুগামীর কথায়, ‘‘বিজেপির ভোট মেশিনারি নয়, ২০০২ সাল থেকে নিজের হাতে গড়া হিন্দু যুবা
বাহিনীর পরিশ্রমের জোরে ভোটে জিতেছেন যোগী। অথচ যাঁরা তাঁর হয়ে ভোট ময়দানে জান কবুল করেছেন, সামান্য প্রয়োজনেও প্রশাসনের দরজায় হত্যে দিতে হয়েছে তাঁদের।’’ আর এক জন বলছিলেন, ‘‘মঠাধ্যক্ষ হওয়ার কারণে যোগীকে মহারাজ বলেন স্থানীয়রা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে নিজেকে সত্যিই তা ভেবে ফেললেন তিনি। লখনউয়ে তাঁর কাছে পৌঁছনো যায় না। মঠের দরবারে যেখানে আগে রোজ ১,২০০-১,৫০০ লোকের ভিড় হত, ১০০-১৫০ জনে নেমে আসার পরে তা বন্ধই
করেছেন যোগী।’’
এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির উপরেই ভরসা করছেন বিজেপি নেতারা। এক জন বললেন, ‘‘অমিতজি এসে কড়া কথা শোনানোর পরে তবে নড়ে বসবেন সকলে। আর ছবি বদলাতে শুরু করবে
মোদীজির জনসভার পরে। লোকে বিজেপি নয়, ভোট দিচ্ছেন তাঁকেই। পাকিস্তানকে শুইয়ে দিয়েছেন, আর বিরোধী জোটকে জব্দ করতে
পারবেন না? তবু যোগী-ফ্যাক্টর থাকবে।’’
২৯ এপ্রিল দেখছিলাম, অমিত শাহকে স্বাগত জানাতে গোলাপের কাঁটা বাছছেন বিজেপির আঞ্চলিক অধ্যক্ষ ধর্মেন্দ্র সিংহ। সমস্যার কাঁটা বেছে হাতে আসনও তুলে দিতে পারবেন কি?
উত্তর যোগীর সুটকেসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy