সে জলও নেই, সে হাওয়াও নেই। তবে পুজোটা কিন্তু রয়ে গিয়েছে মধুপুরের বাঙালিদের!
আজও বর্ষা পড়লেই পুজোর বৈঠক হয় সিদ্ধেশ্বরী দুর্গামন্দিরে। আজও বোধনের ঢাক বাজে। এবং সেই পুজোকে ঘিরেই উস্কে ওঠে স্মৃতি। এই তো সেদিনও বাঙালির মহানায়ক আসতেন, সে দিনও পুজোর ছুটিতে দেখা যেত ‘ফেলুদা’-কে। মণ্ডপের সামনেই মঞ্চে গান শুনিয়েছেন শ্যামল মিত্র-পূর্ণদাস বাউল।
মধুপুর বাঙালির ‘পশ্চিম’, হাওয়া বদলের ঘর। বাঙালির সাহিত্যে-সিনেমায়-গানে জড়িয়ে রয়েছে সে। মধুপুরের আক্ষেপ, দূষণ-আবহাওয়ার জেরে সেই খাঁটি জল-হাওয়া বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে বাঙালির হাওয়াবদলও। এক সময় পুজোর ছুটিতে যে মধুপুর গমগম করত বাঙালি ‘চেঞ্জারে’, এখন সেখানে মধ্যবিত্ত বাঙালি পর্যটক খুঁজে পাওয়া দায়। কলকাতার নায়ক-গায়কেরা তো দূর আকাশের তারা!
মধুপুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জৌলুস হারাচ্ছে উৎসবও। তবু এখনও এই সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পুজোকে আঁকড়ে রয়েছেন কল্পনা ঘোষ, মৃত্যুঞ্জয় সিংহ, দুলাল পাল, মলয় বসু, বরুণ চন্দ্র, শুভেন্দু দাঁর মতো প্রবীণেরা। তাঁদের ঘিরেই উৎসবে মাতেন মধুপুরের বাঙালি পরিবারগুলি। মধুপুরের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল গাঁধীচকের ধর্মশালায়। বিশের দশকে সেই পুজো নিয়ে মতান্তর হয় অবাঙালি আর বাঙালি সদস্যদের। ১৯২৬ সালে বেরিয়ে এসে তৈরি হয় নতুন পুজো। এগিয়ে আসেন রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু। তাঁরই প্রয়াত স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর নামে গড়ে ওঠে সিদ্ধেশ্বরী দুর্গা মন্দির। সেই পরিবারের সদস্য অমরনাথ সাধু এখন এই পুজোর সভাপতি।
স্বাধীনতার পরের দশকে মধুপুর বাঙালিতে ভরপুর। ‘‘ষাট-সত্তরের দশকেও কে না এসেছে এখানে? সৌমিত্র, শুভেন্দু, বিকাশ রায়দের এই পুজোতেই দেখেছি,’’ পুরনো গল্প বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মলয়বাবু। পাশ থেকে শুভেন্দুবাবু বলে ওঠেন, ‘‘পুজোয় তখন গানের জলসা হতো। শ্যামল মিত্র গেয়েছেন সেখানে। হতো যাত্রাপালা-নাটকও।’’
সেই জৌলুস কমলেও আজও মহালয়ায় মাইকে বাজে মহিষাসুরমর্দিনী। কলকাতা থেকে মানিঅর্ডারে পৌঁছে যায় পুরনো কয়েক জন সদস্যের চাঁদা। বাঙালি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা গীতিনাট্যে মাতে। সেই ‘দাদার কীর্তি’র চিত্রাঙ্গদার মতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, শুরু হয়েছে মহিলাদের প্রতিযোগিতা ‘শ্রীমতি সিদ্ধেশ্বরী’। এ বারেও থাকছেন বাউলগান। আজও দুপুরের দেবীর ভোগের পাতে পড়ে গোবিন্দভোগ চাল-মুগডালের খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, ফুলকপির তরকারি আর পায়েস। রাতে বাঙালি রীতি মেনেই দেবী খান লুচি, হালুয়া, বোঁদে। পুজোর সময় মেলা বসে যায় মন্দির চত্বরে।
তবুও আক্ষেপ ঘুরে বেড়ায় সিদ্ধেশ্বরী মন্দির চত্বরে। বাঙালি কমছে মধুপুরে। যদিও বা পরিবার থাকছে, চাকরির খোঁজে নবীনেরা পাড়ি দিচ্ছেন কলকাতা বা ভিন শহরে। ‘‘কেন থাকবে? এখানে তো তেমন চাকরির সুযোগ নেই,’’ পাশ থেকে বলে ওঠেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। তবুও ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গিয়েছেন কয়েক জন। যেমন প্রতিমাশিল্পী সুরজিৎ পাল। তিন পুরুষ ধরে এই পাল পরিবারই এই পুজোর প্রতিমা গড়ে আসছে। সুরজিৎবাবুর ঠাকুর্দা দেবেন্দ্রনাথ পাল নদিয়া থেকে মধুপুরে পাড়ি য়েছিলেন। তাঁর হাতেই প্রথম সেজে উঠেছিল এই পুজোর একচালার প্রতিমা। তাঁর ছেলে সমরকান্তির হাতেও রূপ পেয়েছেন দেবী।
এখনও পুজোর জোয়াল কাঁধে তুলে নেন অনিন্দ্যর মতো কয়েক জন অল্পবয়সী সদস্য। উঠেপড়ে লাগেন পুজোর জোগাড়ে। এই নবীনদের মুখ চেয়েই পশ্চিমি হাওয়ায় দূর পাহাড়ে মিলিয়ে যায় প্রবীণদের আক্ষেপ।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে বেজে ওঠে বোধনের ঢাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy