বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসে যেন ধস নেমেছে! একের পর এক নেতা দল ছাড়ছেন। একই সময়ে দুই বিধায়ক জেলে দিন কাটালেন। দক্ষিণ করিমগঞ্জের বিধায়ক সিদ্দেক আহমেদ জামিন পেলেও বড়খলার প্রতিনিধি রুমি নাথ গাড়ি চুরির মামলায় এখনও জেল হাজতেই।
অভিযোগ, নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে কংগ্রেসে। অথচ এই নেতৃত্ব নিয়েই সন্তোষমোহন দেবের সঙ্গে লাগাতার লড়ে গিয়েছেন কাটলিছড়ার বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম রায়। সন্তোষবাবু অসুস্থ, দিল্লিতে থাকেন। এর পরও গৌতমবাবুর স্বপ্ন কিন্তু পূরণ হয়নি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বরাক উপত্যকা বিষয়ক উপদেষ্টা হলেও বরাকের গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। কংগ্রেস ছেড়ে যাওয়া নেতারা দলত্যাগের কারণ হিসেবে বরাক কংগ্রেসের এই নেতৃত্বহীনতা, দিশাহীনতাকেই দায়ি করছেন।
কয়েকদিন আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন করিমগঞ্জের যুব নেতা কৃষ্ণেন্দু পাল। এর পরই গেরুয়া বাহিনীতে নাম লেখান প্রাক্তন পুরপ্রধান মানস দাস। সেই সঙ্গে শিলচরের ওজনদার নেতা, প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র প্রদীপ দত্তরায়ও দল ছেড়েছেন। গৌতমবাবু বড় ধাক্কা খেয়েছেন গত সপ্তাহে। ক’দিন আগেও তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন হাইলাকান্দি জেলা পরিষদের সদস্য সুজামউদ্দিন লস্কর। গৌতমবাবুই তাঁকে হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেছিলেন। সেই সুজাম এখন তাঁর পাশেও নেই। দলেও নেই।
একের পর এক কংগ্রেস নেতার দল ছাড়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছেন অসমে কংগ্রেসের বাঙালি নেতা গৌতম রায়। কেননা তিরিশ বছর ধরে তিনি নাগাড়ে বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। ছ’বারের বিধায়ক, চার বারের মন্ত্রী। বরাকে দলকে বেহাল অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তাঁকেই যে ভরসা করছেন, উপদেষ্টা নিযুক্তি থেকেই তা স্পষ্ট।
আগামী বছরেই বিধানসভার নির্বাচন। বর্তমানে বরাকের ১৫টি বিধানসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেসের দখলে ১৩টি। এক দিকে মুখ্যমন্ত্রীর ভরসা, অন্য দিকে এই সংখ্যা—দু’টিই এখন গৌতমবাবুর কাছে অস্বস্তির কারণ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে আদায়ি ভোটের পরিমাণকে মন্ত্রিত্ব টেকানোর শর্ত হিসেবে নিয়েছিল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। আর এই কারণেই তখন মন্ত্রীর পদ খোয়াতে হয়েছিল গৌতমবাবুকে। কারণ করিমগঞ্জ লোকসভা আসনটি হাতছাড়া হয় কংগ্রেসের। গৌতমবাবুর একান্ত ঘনিষ্ঠ, দু’বারের সাংসদ ললিত মোহন শুক্লবৈদ্যের অবস্থান ছিল তিন নম্বরে। এমনকী গৌতম রায়ের তিরিশ বছরের ‘খাসতালুক’ কাটলিছড়ায়ও শুক্লবৈদ্য ছিলেন তিন নম্বরেই। ফলে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় মুখ্যমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় ফেরে, আর বরাকে আশানুরূপ ফল না হয়, সে ক্ষেত্রে মন্ত্রী বা মন্ত্রীর সমমর্যাদার ‘উপদেষ্টা’ কিছুই মিলবে না। উল্টে হাইকম্যান্ডের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। এর উপর নিজের আসনটি যদি ধরে রাখতে না পারেন, তবে তো আম আর ছালা, সবই গেল।
গৌতম রায় এ পর্যন্ত সাত বার নির্বাচন লড়ে ছ’বার জিতেছেন। একমাত্র ১৯৮৩ সালে হাইলাকান্দি কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছিলেন। তারপর এক নাগাড়ে কাটলিছড়ার বিধায়ক। স্ত্রী মন্দিরা রায় আলগাপুরের বিধায়ক। গত বছর উপ-নির্বাচনে কঠোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি স্ত্রীকে জিতিয়ে আনেন। কিন্তু এই প্রথম ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’ তাড়া করছে গৌতমবাবুকে। এমনই অনিশ্চয়তা যে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নিয়েও ধোয়াশা সৃষ্টি করে রেখেছেন। একবার ‘আর লড়বেন না’ বলছেন, পরক্ষণেই বলছেন, ‘আগামী বছরের ভোটেও জিতব, ফের মন্ত্রী হব।’ কাছাড়ে এসে বললেন, ‘হাইলাকান্দির কাটলিছড়াই আমার নিরাপদ আসন।’ আবার কাটলিছড়া গিয়ে বলছেন, ‘কাছাড়ের কাটিগড়া থেকে নিত্য আব্দার, সেখান থেকেই লড়তে হবে।’
নেতার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে হাইলাকান্দিতে ব্যাপক ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বিজেপি এবং এআইইউডিএফ। লোকসভা ভোটের নিরিখে বরাকের ১৫টির মধ্যে করিমগঞ্জ-সহ তিনটি বিধানসভা আসনে প্রথম স্থানে বদরুদ্দিন আজমলের দল। কংগ্রেস ছেড়ে এআইইউডিএফ টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে করিমগঞ্জ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন রাধেশ্যাম বিশ্বাস। বিধানসভা ভোটেও গৌতম রায়ের কাটলিছড়ায় কংগ্রেস থেকে আসা সুজামউদ্দিনকে দাঁড় করিয়ে বাজিমাত করতে চাইছেন আজমল-রাধেশ্যামরা। দল ছেড়েই সুজাম কাটলিছড়া আসনে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, ‘‘হাইলাকান্দি কংগ্রেসে গণতন্ত্র নেই। এখানে ব্যক্তির (পড়ুন গৌতম রায়) মত শেষ কথা। গৌতম-রাজত্বে যোগ্য লোকের কদর মেলে না। তাই দল ছেড়ে বিকল্প পথের সন্ধান করছি।’’
তাঁর এই ঘোষণা গৌতমবাবুকে আরও দুশ্চিন্তায় রেখেছে। কারণ সুজামউদ্দিনের পিতা ছিলেন কাটলিছড়ার দু’বারের বিধায়ক।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy