কার কীর্তি, কেউ জানে না। কিন্তু গোটা উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে হোয়াট্সঅ্যাপ ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওটি পুরনো। তাতে দেখা যাচ্ছে মায়াবতী নিজেই বলছেন, বহুজন সমাজ পার্টির ভোট তিনি বিজেপির ঝোলায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। গত কয়েক দিন ধরে প্রচারে ঠিক এটাই বলছেন অখিলেশ যাদব। তাঁরও দাবি, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বসপা-র ভোট বিজেপিতে পাচার করেছিলেন মায়াবতী। তার ফলেই উত্তরপ্রদেশের ৮০টি আসনের ৭১টিই পকেটে পুরেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা। দ্বিতীয় স্থান পেলেও সমাজবাদী পার্টির জুটেছিল মাত্র ৫টি আসন। আর ২০০৯-এ ২০টি আসন পাওয়া বসপা-র খাতায় ছিল শূন্য।
দিল্লি ও লখনউয়ের হাওয়ায় খবর ভাসছে, এ বারেও বিজেপি নেতৃত্ব তলে তলে মায়াবতীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, অরুণ জেটলির সঙ্গে মায়াবতীর বিশ্বস্ত নেতা সতীশ মিশ্রের দু’বার বৈঠকও হয়েছে। বিজেপি বার্তা দিয়েছে, অখিলেশ ও রাহুল গাঁধীর জোট যাতে সরকার গড়তে না পারে তার জন্য ভোটের পরে দরকারে মায়াবতীকে সমর্থন করবে বিজেপি। এবং এই কৌশলের অঙ্গ হিসেবেই বিজেপি সভাপতি অমিত উত্তরপ্রদেশে গিয়ে বলছেন, কংগ্রেস-সপা জোট তুচ্ছ। মায়াবতীর সঙ্গেই বিজেপির আসল লড়াই। অথচ মায়াবতীকে তেমন আক্রমণ না করে তুলোধোনা করছেন অখিলেশ-রাহুলদের।
মায়াবতী অবশ্য সকাল-বিকেল মোদী সরকার ও বিজেপিকে আক্রমণ করছেন। মোদী উত্তরপ্রদেশে জনসভা শেষ করতে না করতেই মায়াবতী তার পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। যাতে বিজেপির সঙ্গে আঁতাঁত নিয়ে কারও মনে সংশয় তৈরি না হয়। ভোট পর্যন্ত এটা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায়ও নেই মায়াবতীর। কারণ এ বার তিনি চিরাচরিত দলিত ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে মুসলিম ভোট যোগ করতে চাইছেন। যে কারণে দলিতদের থেকেও বেশি, মোট ৯৭ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছেন এই ভোটে। গত বিধানসভা ভোটের থেকে সংখ্যাটা এক ডজন বেশি। ফলে নির্বাচনের আগে বিজেপির সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় ভাবটি তাঁকে বজায়ে রাখতেই হবে।
মায়াবতীর পাটিগণিতটা খুব স্পষ্ট। ২০১১-র জনগণনায় দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যার ২০.৭% দলিত, ১৮.৫% মুসলিম। দুইয়ে মিলিয়ে ৩৯.১% মানুষের বেশির ভাগের ভোট পেলে পঞ্চম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া তাঁর নিশ্চিত। কারণ অখিলেশ মাত্র ২৯% ভোট পেয়েই গত পাঁচ বছর ধরে সরকার চালাচ্ছেন। বিজেপির হিসেব অন্য। দলিত-মুসলিমের সব ভোটই মায়াবতীর ঝোলায় যাবে, এমন মনে করার কারণ নেই। মায়াবতীর সংখ্যায় টান পড়লে তখন তাঁর পাশে দাঁড়াতে চায় বিজেপি। দু’দলের নেতারাই মনে করছেন, কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি যদি বিজেপির সঙ্গে জোট করে সরকার গড়তে পারেন, তা হলে মায়াবতীর অসুবিধে কোথায়!
আরও পড়ুন। ধর্ষিতার হত্যায় অভিযুক্ত বিধায়ক, প্যাঁচে অখিলেশ
রাজ্যের মুসলিম ভোট দীর্ঘদিন ধরেই মুলায়ম-অখিলেশদের বড় ভরসা। মায়াবতী সেই ভোটব্যাঙ্ক ধরে টান দেওয়ায় প্রচারে অখিলেশ বলছেন, ‘‘বসপা-নেত্রী আসলে বিজেপির হয়ে মুসলমান ভোটে ভাঙন ধরাচ্ছেন। এর আগে দু’বার ১৯৯৪ ও ২০০২-এ বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন তিনি।’’
সতীশ মিশ্রের মতো মায়াবতীর দলের নেতাদের পাল্টা যুক্তি, গাঁটছড়া বাঁধলেও বিজেপির কাছে বসপা নিজের মতাদর্শ বিসর্জন দেয়নি। প্রমাণ? ১৯৯৫-এ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মথুরায় একটি জমিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির তৈরি করবে বলে লাগোয়া একটি মসজিদ ভাঙার দাবি তুলেছিল। মায়াবতী তা হতে দেননি। রাম জন্মভূমি বিতর্কে লিবেরহান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের সময়ও তিনি শক্ত হাতে আইন-শৃঙ্খলা সামলেছিলেন। সেই তুলনায় অখিলেশের জমানাতেই মুজফ্ফরনগর কাণ্ডে বহু সংখ্যালঘুর মৃত্যু হয়েছে। এ সব তথ্য নিয়ে ‘মুসলিম সমাজের আসল হিতৈষী কে! নামক প্রচার-পুস্তিকা তৈরি হয়েছে। দিল্লি জামা মসজিদের শাহি ইমাম, রাষ্ট্রীয় উলেমা পরিষদ থেকে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদ বসপা-কে সমর্থন জানিয়েছে। সমস্যা একটাই। মায়াবতীর দলে সপা-র আজম খানের মতো বড় মাপের সংখ্যালঘু নেতা নেই। সবেধন নীলমণি বিধান পরিষদের সদস্য নসিমুদ্দিন সিদ্দিকী। তিনিই মুসলিম সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আসাদুদ্দিন ওয়েইসিও মায়াবতীর সঙ্গে হাত মেলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মায়াবতী তাঁর ব্রাহ্মণ ভোটে ভাঙনের ভয়ে সে পথ মাড়াননি।
লখনউয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মায়াবতীর কাছে এ বার ক্ষমতায় ফেরা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ লোকসভা ভোটে একটিও আসন পায়নি তাঁর দল। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, এক সময় প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে উঠে আসা মায়াবতীর রাজনীতি শেষ। অথচ, লোকসভা ভোটে সারা দেশে ভোটের হারের হিসেবে বিজেপি-কংগ্রেসের পরেই বসপা তৃতীয় দল। শুধু উত্তরপ্রদেশের নিরিখে সপা-র সঙ্গে বসপা-র ফারাকও ছিল সামান্য। ৩৪টি আসনে বসপা-প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। এবারের ভোট তাই মায়াবতীর কাছে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার লড়াই।
বিজেপি নেতারা মনে করছেন, মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী হলেও তাঁদের লাগামে থাকবেন। কারণ তাঁর ও তাঁর ভাই আনন্দ কুমারের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ। মায়াবতীর শেষ জমানার সাত বছরে আনন্দের সম্পত্তির পরিমাণ সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১৩১৬ কোটি টাকা ছুঁয়েছিল। ডিসেম্বর মাসেই ইডি বসপা-র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০৪ কোটি টাকা জমা ও তাঁর ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে ১.৪৩ কোটি টাকা জমার সন্ধান পেয়েছে। মায়াবতীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই তদন্তকেই চাবিকাঠি করতে চান বিজেপি নেতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy