কেক কেটে নয়, বেলুন ফাটিয়েও নয়। জমজমাট আলোচনায় ৪৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করল শিলচরের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘গণসুর’। অন্য কোনও ভাবে তা এত ব্যঞ্জনাময়, এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠত কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
ঐতিহ্যের পথে হেঁটে বর্তমানের সঙ্কট স্পর্শ করে ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নে বিলীন হওয়ার মধ্যেই ত্রিকাল-ভ্রমণ করল সেই আলোচনা। তার কেন্দ্রে ছিলেন ৫ জন— শেখর দেবরায়, ইন্দ্রনীল দে, বিশ্বজিৎ শীল, শান্তনু পাল ও দেবারতি চন্দ। তাঁদের প্রত্যেকে উপত্যকার নাট্য আন্দোলনের একেকজন অগ্রণী সেনানায়ক। ত্রিকালমাত্রিক ওই আলোচনাকে নির্দিষ্ট গতিপথে এগিয়ে নিয়ে গেলেন সঞ্চালক সুব্রত রায় ওরফে শম্ভু।
নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা শেখর দেবরায়ের প্রতিটি শব্দ যেন অন্তর থেকে উঠে আসা জীবনসংগ্রামের কথা। তিনি মনে করেন, নাট্যচর্চা আর নাট্যাভিনয় এক নয়। শিলচর শহরের শতবর্ষের নাট্যাভিনয়ের ঐতিহ্য থাকলেও নাট্যচর্চার ইতিহাস সত্তরের দশক থেকে শুরু। কলকাতাভিত্তিক নাটকের বিপ্রতীপে নিজেদের ধারা প্রতিষ্ঠিত হল। যিশু চন্দের ‘প্রমিথিউস’, সুজয় ভট্টাচার্যের ‘কঙ্কাল’-এর মধ্যে দিয়ে নাটক লেখার যে ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও বহমান। দীনবন্ধু মিত্রের মতো বিখ্যাত নাট্যকার শিলচরে বসে নাটক লিখেছেন। এক সময়ে নগেন্দ্র শ্যাম নাটক লিখেছেন। কিন্তু পরে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। এখানে নাটক নিয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটে মূলত গণনাট্যের প্রভাবে। বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ অনুঘটকের কাজ করেছে। নাটক জীবনের কথা বলে, সময়ের কথা বলে। সময় ও জীবনের কথা বলতে বলতে আপন ছন্দে এগিয়ে চলে বিবর্তনের পথরেখায়। এই চলা সময়ের কাছে হার মেনে নয়, সময়কে শাসন করে, সময়কে পথনির্দেশ করে। নাট্যচর্চা তাই নাট্য আন্দোলনের সমার্থক। বেশিরভাগ শিল্পচর্চায় থাকে একক প্রয়াস, নাটকে থাকে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রয়াস। শিলচরের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে, যেমন সাহিত্যের পথে নাটকের মিলনসেতু তৈরি হয়নি। অথচ নাটক সাহিত্যেরই অন্যতম উপাদান। এখানকার লেখকদের অনুসরণে নাটক সৃষ্টি হচ্ছে না। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’কে ভিত্তি করে ‘বিসর্জন’ বা শরৎচন্দ্রের ‘পল্লিসমাজ’-এর উপর নির্ভর করে ‘রমা’ নাটক তৈরি হয়েছে। সেই ধারা এখানে অনুপস্থিত। আরও সমস্যা আছে। যেমন বরাকে অভিনয়শৈলী শেখার জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। থিয়েটার বিষয়ক কোনও পত্রিকা নেই।
শহর থেকে অনেক দূরে থেকেও নিয়মিত নাট্যচর্চা আন্তরিক ভাবে চালিয়ে য়াচ্ছেন ইন্দ্রনীল দে। প্রান্তিক অঞ্চলে থেকেও বাংলা নাটকের বৃহত্তর ভুবনের সঙ্গে যাঁর মানসিক মিলনসেতু তৈরি হয়, তাঁর কাছে নতুন কথা শোনার প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই প্রত্যাশা পূরণে তিনি নিরাশ করেননি। ইন্দ্রনীলের কথায় বর্তমান সময়ের সংকট ধরা পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘দ্রুতগতির জীবনে ধ্রুপদী উপন্যাসের জায়গায় এসেছে অনুগল্প। টেস্ট ক্রিকেটের জায়গায় এসেছে টি-২০। একসময়ের পূর্ণাঙ্গ নাটককে পিছনে ফেলে চলে এসেছিল একাঙ্ক নাটক। আজকের প্রয়োজনে আরও ছোট নাটকের দিকে যেতে হবে।’’ তাঁর বক্তব্য, রূপ থেকে রূপান্তরের পথে সময়ের দাবি মেনে নাটককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর সঙ্গে বাজার অর্থনীতির নিয়মনীতি মেনে বদলে যাওয়া রুচি-অভিরুচির কথা মাথায় রেখে বিষয় নির্বাচন করতে হবে। আত্মসমালোচনা করে পূর্বসুরিদের দায় মাথায় নিয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘যতই শতবর্ষের ঐতিহ্য থাক না কেন, আজও নাটক মূলত শহরকেন্দ্রীক। প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ আজও নাট্যসমাজে ব্রাত্য। ব্রাত্য তাদের জীবনসংগ্রাম।’’ তিনি জানান, প্রসেনিয়াম মঞ্চের সীমাকে সীমিত করে ছোট মঞ্চে কম দর্শকের সামনে নাটককে নিয়ে আসতে হবে। বাদল সরকার এই প্রয়াস হাতে নিয়েও সফল হননি। কেননা একটা বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তায় দীক্ষিত বাদলবাবু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।
গণসুরের সে দিনের আলোচনায় বিশ্বজিৎ শীল যেমন মঞ্চের এপার থেকে বলেছেন, ওপার থেকেও বলেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘এই উপত্যকার বিশেষ করে, এই শহরের একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি হয়েছে। নাটকের একটা অংশ দেখে বলা যাবে, কোন নাটক কার।’’ তিনি প্রয়াত বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘‘বিশ্বজিৎ ছিলেন থিয়েটার মেকার। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ তিনিই করতেন। একই কথা শেখর দেবরায়, শান্তনু পাল, চিত্রভানু ভৌমিক সম্পর্কেও বলা যেতে পারে।’’
সাম্প্রতিককালে এই অঞ্চলের নাট্যকারদের নাটক মুদ্রিত বই হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে, এই অঞ্চলের নাট্যচর্চার বহমান স্রোত বেগবান নদীর মতো সমুদ্রে ধাবমান। নাট্যকার শেখর দেবরায় ও চিত্রভানু ভৌমিকের লেখা নাটক বহির্বরাকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে, তাকে গর্বের বিষয় বলে চিহ্নিত করেন বিশ্বজিতবাবু।
শান্তনু পালের মতে, টেলিভিশনের ‘সোপ অপেরা’ সামগ্রিক ভাবে নাট্যচর্চাকে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে। একে মোকাবিলা করতে হলে বিষয়ের দিক থেকে শুধু নয়, আঙ্গিকের দিক থেকেও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। শান্তনু আশাবাদী, সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে যৌথ প্রয়াসের প্রয়োজন। ঘন ঘন নাট্য কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। সাহিত্যিকদের সঙ্গে নাটকের আত্মীয়তা বাড়াতে হবে।
তবে নাটকের গবেষক ও অভিনেত্রী দেবারতি চন্দ নাটক নিয়ে পড়াশোনার উপর গুরুত্ব দেন। সঙ্গে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তা হচ্ছে না বলে। দর্শকের অভাব তাঁকে ভাবায়। নাটক সাহিত্যের দিক ও ক্রিয়াশীল শিল্পের মধ্যে বিভাজন টেনে বলেন, ‘‘সময় এবং সমাজের দ্বন্দ্ব যদি মূর্ত না হয়, তবে নাটক ব্যর্থ।’’ প্রসঙ্গক্রমে তিনি অসমের নাগরিকত্বের সমস্যার কথা তুলে ধরেন ও মণিপুরের শর্মিলা চানুর কথা টেনে আনেন। তিনি বলেন, ‘‘এই সব বিষয় বাদ দিয়ে নাট্যচর্চা শুধু বিনোদনই হবে, যা মোটেই কাম্য নয়।’’ আলোচনার শেষ দিকে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা বিতর্কে মেতে ওঠেন। অমিত শিকিদার, মহাদেব বণিক, সুব্রত ভট্টাচার্য, চিত্রভানু ভৌমিক, বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী-সহ কয়েক জনের যোগদানে আলোচনাসভা এই উপত্যকার নাট্য আন্দোলনের ‘মাইল-ফলক’ হয়ে থাকবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy