আনুষ্ঠানিকতায় এটি রাজ্যপালের ভাষণ। কিন্তু আদতে সরকারে সদ্য ক্ষমতাসীন বিজেপির ইস্তাহারেরই পরিমার্জিত সংস্করণ। সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা-রূপরেখা। নিঃসন্দেহে খুবই উচ্চাভিলাষী। কারণ রাজকোষ তো শূন্য! অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা জানিয়েই দিলেন, ‘‘ফাঁকা ভাঁড়ার দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু মানুষের উন্নয়ন তো সরকারকে করতেই হবে। সরকার প্রতিশ্রুত।’’
স্বাধীনতার সময় অসম ভারতের উন্নত রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম পাঁচে ছিল। হৃত সম্মান ফেরাতে ‘রিস্টার্ট অসম’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। টানা পৌনে দু’ঘণ্টা ধরে সরকারের তৈরি করে দেওয়া ৫০ পাতার ভাষণটি পড়ে গেলেন অশীতিপর রাজ্যপাল পদ্মনাভ বালকৃষ্ণ আচার্য। অসম বিধানসভায় শেষ কবে কোনও রাজ্যপাল তাঁর ভাষণের পুরোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বা পড়তে পেরেছেন তা প্রবীণ বিধায়কদের অনেকেই মনে করতে পারলেন না!
রাজ্যপালের ভাষণে, সরকারি কর্মসূচির প্রথমেই ছিল অসম চুক্তির রূপায়ণ। তিনি বলেন: বাংলাদেশ সীমান্ত পুরো বন্ধ করা, বিদেশিদের শণাক্তকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা, বায়ো-মেট্রিক পদ্ধতির সাহায্যে ভোটার তালিকা ঢেলে সাজা ও নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। নতুন থানা, থানায় থানায় মহিলা শাখা ও পুলিশকে মানবিক করে তোলার উপর জোর দেন তিনি। তিনি জানান, বেকারত্ব দূর করতে সরকার ‘নিয়োগ মেলা’, ‘দরিদ্র কল্যাণ মেলা’ করবে। কিন্তু ‘কাজ’ কোথা থেকে আসবে তা স্পষ্ট নয়। রাজ্যে আইটি হাব তৈরি করে বিপিও-র চাকরির একটা সন্ধান অবশ্য দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ‘অম্রুত’ প্রকল্পের আওতায় উন্নত করা হবে গুয়াহাটি, শিলচর, নগাঁও-সহ ১৩টি শহরকে। গুয়াহাটিকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন রাস্তা তৈরি, সাবওয়ে তৈরি, কৃত্রিম বন্যা রোধে বিশেষ নিকাশি ব্যবস্থা হাতে নেওয়া, শহর সংলগ্ন পাহাড়গুলি ধ্বংস না করা, শহর ও শহরতলিতে ‘সিটি বাস’-এর ব্যবস্থা ছাড়াও গুয়াহাটিতে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা রাজ্যপাল ব্যক্ত করেছেন।
খাদ্য-সুরক্ষার ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া তাঁর সরকার নিশ্চিত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন রাজ্যপাল। পাশাপাশি, খাদ্য ও গণবণ্টন সমস্যাগুলি দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্যও সরকার উদ্যোগী হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। একই সঙ্গে অসমের বিখ্যাত একশৃঙ্গ গন্ডারদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন তিনি। গন্ডার হত্যা প্রতিরোধে ‘বিশেষ গন্ডার হত্যা প্রতিরোধ বাহিনী’ তৈরির পরিকল্পনা সোনোয়াল সরকারের রয়েছে। বন্যপ্রাণ সম্পর্কিত মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি, সব অরণ্য অঞ্চলে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হবে। শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশের জন্য গত কালই ‘ইজ অফ ডুইং বিজনেস’ বিল তৈরি করছে সরকার। রাজ্যপাল জানান, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির মেলবন্ধনে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘ব্রান্ড অসম’ গড়ে তোলাই সরকারের লক্ষ্য। বিনিয়োগকারীদের জন্য নিয়মিত বৈঠক করা, উপদেষ্টা নিয়োগ, শিল্প নীতি ঢেলে সাজান, সড়ক পরিকাঠামো উন্নয়ন, উদ্বৃত্ত সরকারি ভূমি নিয়ে জমি ব্যাঙ্ক গড়া, বন্ধ থাকা শিল্প পুনরুজ্জীবন ও কুটির শিল্প উন্নয়নে ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের ‘উচ্ছেদ’ করা হবে না।
চা বাগানের ভোট এবার বিরাট সংখ্যায় বিজেপির দিকে এসেছে। রাজ্যপাল জানান, শিল্প বিকাশে রুগ্ন বাগিচার পুনরুজ্জীবন, বিদেশের চা নিগমের সঙ্গে মত বিনিময়, আধুনিক চা কারখানা তৈরি, চা পর্যটনকে উৎসাহ দেওয়া, সরকার নির্ধারিত সব সুবিধে বাগান শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, বাগানের উদ্বৃত্ত জমিতে চা শ্রমিকদের জন্য গৃহ নির্মাণ, সব শ্রমিক পরিবারকে বিদ্যুতের মিটার দেওয়া, বাগানে ক্রেশ গড়া ও ইলেকট্রনিক চা নিলাম শুরু করায় জোর দেবে নতুন সরকার। বন্যা ও ভূমিক্ষয় রোধে বিশেষ জোর দেবে সরকার। ভূমিক্ষয় থেকে মাজুলিকে রক্ষা করার উপরে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। বরাক উপত্যকায় সড়ক মেরামতি ও বরাক নদীর উপরে আরও সেতু তৈরির ভরসা রাজ্যপালের মাধ্যমে দিয়েছে নতুন সরকার। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদীতে জলপরিবণ ব্যবস্থা গড়ে তোলায়ও জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নতুন সরকার সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে পর্যটন বিকাশে। এ ক্ষেত্রে ‘ব্র্যান্ড অসম’ গড়ে অসম পর্যটনকে আরও বেশি করে বিশ্বার দরবারে পৌঁছে দেওয়াটা এই সরকারের বড় কাজ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে পর্যটন-ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো, ভূমিপুত্রদের উৎসাহ দিয়ে পর্যটন সংস্থা, ‘হোম-স্টে’ ও ইংরাজি জানা গাইড তৈরির উদ্যোগ নেবে সরকার। বিভিন্ন রাজ্যে অসম পর্যটন বিপণী গড়া এবং পর্যটনে ‘এক-খিড়কি নীতি’ নেওয়ায় জোর দেন রাজ্যপাল। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া ক্ষেত্রেও বিশেষ জোর দেওয়া হবে। রাজ্য স্তরে খেলোয়াড়দের সম্মান দেওয়া হবে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের নিয়োগে সুবিধে দেওয়া হবে। রাজ্য, জেলা, মহকুমা পর্যায়ে খেলা হবে ‘মুখ্যমন্ত্রী ফুটবল কাপ’। সংখ্যালঘু উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের নতুন বিজেপি সরকার। গরিয়া, মরিয়া, মাইমল, জালোয়া-সহ ভূমিপুত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতি, তাদের পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণায় জোর দেওয়া হবে। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব কলাক্ষেত্রের আদলে ‘আজান পীর কলাক্ষেত্র’ তৈরি করবে সরকার। কলাক্ষেত্র গড়া হবে বরাক ও রাজ্যের অন্যত্রও। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অসম অধ্যয়ন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। কলা-সাংবাদিকতা-সংস্কৃতিক্ষেত্রে এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ অনুসরণ করেই সর্বানন্দ সোনোয়াল শীঘ্রই চালু করতে যাচ্ছেন ‘অসমভূষণ’ পুরস্কারও।
এত কিছু ঘোষণার পর ভাষণ শেষে রাজ্যপাল জানান, ভাঁড়ারের অবস্থা শোচনীয়। কোনও মতে বেতন ও পেনশনের টাকা দেওয়া হচ্ছে। রয়েছে বিস্তর ঋণের বোঝাও। তাই পরিস্থিতি সামলাতে সরকার কয়েকটি কঠোর সিদ্ধান্তও নেবে। ১৯৩৭ সাল থেকে চলা কোষাগার নীতির স্থানে নতুন কোষাগার বিধি আনা হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কের সাহায্য নেবে সরকার। অর্থনীতি শক্তিশালী করতে ‘অ্যাসপায়ার’ নামে একটি অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে চলেছেন সর্বানন্দ সরকার। বিধানসভার লবিতে অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা জানান, ‘‘আগামিকাল রাজকোষের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বিষয়ে বিধানসভায় সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy