কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের (সিএসটি) আওতায় রাজ্যগুলির বকেয়া পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। ২০১৫-’১৬ অর্থবছর অবধি এই হিসেব। এই টাকার সিংহভাগ না-পেলে জিএসটি চালু হওয়া মুশকিল, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। এমনকী, রাজ্যগুলির নিজস্ব কর আদায়ের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়েও আপত্তি রয়েছে।
সিএসটি তুলে দিয়ে সারা দেশে অভিন্ন পরিষেবা কর (গুডস সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি) চালু করতে গেলে ২৯টি রাজ্যের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আপাতত ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলিকে মেটাবার ব্যবস্থা নিয়েছিল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক। তার ফলে গত বছর এ রাজ্যের বকেয়া প্রাপ্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু এনডিএ সরকার শেষ পর্যন্ত সে টাকা দেওয়া স্থগিত রাখে। রাজ্যগুলির স্তরে কয়েকটি বিশেষ উৎপাদনের উপর কর আদায়ের অধিকার এবং সিএসটি প্রত্যাহারের জন্য ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং ২৮টি রাজ্যের অধিকাংশই জিএসটি চালুর পক্ষে রায় দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের খাতে এ রাজ্যের পাওনার হিসেবটা এ রকম: ২০১১-’১২ সালের জন্য ১২০০ কোটি টাকা। ২০১২-’১৩ সালে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৯৯.২৬ কোটি টাকা। ২০১৩-’১৪-য় ১৭২২.০৯ কোটি টাকা। ২০১৪-’১৫ সালে ১৯৮১.৯২ কোটি এবং ২০১৫-’১৬-য় ২১২১.০৬ কোটি টাকা। অর্থাত্, পাঁচ বছরে সব মিলিয়ে ৮৫২৪ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকার বকেয়া দেয়নি কেন্দ্র। বিহারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীদের এমপাওয়ার্ড কমিটির প্রাক্তন প্রধান সুশীল মোদী ফোনে বলেন, ‘‘সিএসটি থেকে রাজ্যের প্রাপ্য পাওনার যৌক্তিকতা খুঁজে দেখতে এমপাওয়ার্ড কমিটির সদস্য সচিব সতীশ চন্দ্র এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব রেশমি বর্মাকে নিয়ে তৈরি কমিটি তার রিপোর্টে বলেছে, কোনও পূর্বনির্ধারিত পদ্ধতি এবং আলোচনা ছাড়াই রাজ্যগুলির বকেয়া প্রাপ্য কাটা হয়েছিল। ওই রিপোর্টটি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকও স্বীকার করে নেওয়ায় বলাই যায়, রাজ্যগুলির বকেয়া ৩৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত দিতে সম্মত হয় কেন্দ্র। কিন্তু তাই বা হল কোথায়?’’
আরও পড়ুন: মোদী-গড়ে ঝড় থামাল সনিয়ার জ্বর
এমপাওয়ার্ড কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানান, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর (সিএসটি) বিলোপ করে জিএসটি চালুর ব্যাপারে ইউপিএ সরকারের সিদ্ধান্ত ২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে নীতিগত সমর্থন জানানো হয়। বহু রাজ্যও জিএসটি-র ধারণাকে সমর্থন করে। কিন্তু কয়লার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ‘সেস’ আদায় বা পেট্রোল উত্তোলনের জন্য অসম যে কর পায়, তা কি বন্ধ হয়ে যাবে? রাজ্যগুলির এ ধরনের বিভিন্ন নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
সম্প্রতি কলকাতায় এমপাওয়ার্ড কমিটির বৈঠকে তামিলনাড়ু বাদে সব রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ও সচিবেরা জিএসটি চালুর পক্ষে ঐকমত্য হন বলে জানান কমিটির চেয়ারম্যান অমিতবাবু। কিন্তু সিএসটির বকেয়া পাওনা এবং রাজ্যগুলির সেস বা কর আদায়ের অধিকার সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার দু’টি বিষয়ের এখনও সমাধা হয়নি। বস্তুত, ২০০৯-এর ৬ জুলাই সংসদে বাজেট অধিবেশনে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ২০১০-এ জিএসটি চালু হবে। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুর সমাধান না-হওয়ায় চালু হতে পারেনি। কথা ছিল, পর্যায়ক্রমে জিএসটি চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর থেকে রাজ্যগুলি আর তাদের প্রাপ্য অংশ পাবে না। সেই ঘাটতি পূরণ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই অনুযায়ী ২০১০-’১১ থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
জিএসটি চালুর ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আপত্তি রয়েছে।
•বাণিজ্যিক গাড়ির প্রবেশ কর। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, বিহার, রাজস্থান, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সহ মোট ১৯টি রাজ্যে এই কর চালু আছে।
•পারচেজ ট্যাক্স। পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো খাদ্যশস্য উত্পাদক বড় রাজ্যে মূলত গম ও চাল কেনার ক্ষেত্রে প্রতি টনে ১৪.৫০-১৫.০০ শতাংশ কর চালু আছে। তামিলনাড়ুর আছে বস্ত্র, গাড়ি তৈরি ইত্যাদির উপর কর। এ ছাড়া প্রমোদ কর, মদ ইত্যাদি থেকে আদায় হয় রাজস্ব।
জিএসটি চালু হলে এই করগুলি বিলোপ করা চলবে না, এমনটাই দাবি রাজ্যগুলির। অমিতবাবু বলেন, “রাজ্যগুলির হাতে টাকা ছাপানোর ক্ষমতা নেই। রাজস্ব আদায়ের উত্স খুবই কম। যেগুলো আছে, তাও যদি জিএসটি-র চাপে বন্ধ হয়ে যায়, রাজ্যকে নিশ্চিত ভাবেই কেন্দ্রের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে হবে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একটিমাত্র কর ব্যবস্থা বা জিএসটি চালু করতে গেলে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা চলবে না, এমনটাই মনে করেন সব রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তবে এই সমস্যাগুলির সমাধান আর বেশি দূরে নেই।”
এই ব্যাপারে ‘এমপাওয়ার্ড কমিটি’র আর এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবদুল রহিম রাঠের বলেন, “বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই মোদী কিছু দিন আগেও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সিএসটি এবং জিএসটি-র প্রভেদ, এতে রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়া ইত্যাদি সবই তিনি জানেন। ফলে রাজ্যের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর চেয়ে ভাল কে বুঝবে? তাই ক্ষমতায় বসেই তার বিহিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি।”
কিন্তু এ প্রসঙ্গে তামিলনাড়ু যে আপত্তি তুলেছে, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেরও একটা মিল আছে। ‘‘তামিলনাড়ু সরকার বিনামূল্যে ল্যাপটপ দেওয়া থেকে অল্প খরচের ক্যান্টিন অবধি বিভিন্ন ধরনের খয়রাতি কর্মসূচি চালায়। এ সবের ফলে সে রাজ্যের সরকার ঋণের পরিমাণ বহুগুণ বাড়াতে বাধ্য এবং স্ফীতকায় বার্ষিক বাজেটকে ঘাটতিশূন্য করতে গিয়ে এই ঋণের উপরেই ভরসা করতে বাধ্য,’’ বলেছেন ম্যাড্রাস স্কুল অফ ইকনমিক্সের প্রাক্তন ডিরেক্টর কে আর সম্মুগম। এই সব কর্মসূচিতে খরচের অঙ্ক বিপুল। অন্য দিকে, তামিলনাড়ু বস্ত্র, গাড়ি, চামড়া, ওষুধ ইত্যাদি উৎপাদন শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বলে পরিচিত। এ সব শিল্প থেকে বিক্রয় কর ও ভ্যাটের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ আদায় হয়, তা রাজ্যের মোট রাজস্বের ৭০ শতাংশের উপর। এর উল্লেখযোগ্য অংশই জিএসটি-র আওতায় চলে যাবে। এই করের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওন ট্যাক্স রেভিনিউ’। মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার আপত্তির কারণ এইটিই। সেই কারণে জিএসটি গ্রহণ করলে তামিলনাড়ুকে হয় তার বহু খয়রাতি প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হবে, নতুবা বিরাট পরিমাণ অর্থ ঋণ করে কর মেটাতে হবে।
যদিও হাওড়ায় যন্ত্রাংশ তৈরির শিল্প উঠে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গকে আর ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ রাজ্য বলা হয় না। কিন্তু খয়রাতি কর্মসূচিতে তামিলনাড়ুর সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা রয়েছে । ফলে এ রাজ্যেও সিএসটি ও ভ্যাটের মাধ্যমে আদায়ীকৃত অর্থের একটা সিংহভাগই জিএসটির অধীনে চলে যাওয়ার পরিস্থিতি আছে। ফলে একই ভাবে খয়রাতি বা কল্যাণমূলক কর্মসূচির জন্য অফেরতযোগ্য বিপুল অঙ্কের টাকার ঘাটতি মেটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকেও হয় ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে, অথবা খয়রাতি কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy