Advertisement
০২ মে ২০২৪
টাকার চিন্তায় ধৈর্যে চিড়

সে কি এল? দীর্ঘ অপেক্ষা ব্যাঙ্ক এবং এটিএমে

বাড়ির লোকের আশা ছিল, আজ অন্তত রোগীর ব্যান্ডেজ খোলার দিনটা বলবেন হাসপাতালের ডাক্তার। পৌঁছে জানলেন, রোগী আইসিইউ-তে!

অগত্যা ফুটপাথেই। ব্যাঙ্কের দীর্ঘ লাইনে নাকাল গুজরাত থেকে আসা বৃদ্ধ। শনিবার বি বা দী বাগে। ছবি: সুমন বল্লভ।

অগত্যা ফুটপাথেই। ব্যাঙ্কের দীর্ঘ লাইনে নাকাল গুজরাত থেকে আসা বৃদ্ধ। শনিবার বি বা দী বাগে। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

বাড়ির লোকের আশা ছিল, আজ অন্তত রোগীর ব্যান্ডেজ খোলার দিনটা বলবেন হাসপাতালের ডাক্তার। পৌঁছে জানলেন, রোগী আইসিইউ-তে!

শনিবার টাকা তুলতে গিয়ে দেশ জুড়ে মানুষের অভিজ্ঞতা অনেকটা এই রকমই। ভেবেছিলেন, তিন দিন কেটে যাওয়ার পরে এ বার নোট পাওয়া সহজ হবে, ঘটল উল্টো— সারা দিন হয়রানির শেষ থাকল না।

শুক্রবারের মতো এ দিনও খালি হাতে ফিরিয়েছে বেশির ভাগ এটিএম। তার উপর লম্বা লাইন দিয়েও নোট মেলেনি প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্কের বহু শাখায়। ফলে, এখনও ফাটল না হলেও, চিড় ধরছে ধৈর্যের বাঁধে। এক দিকে, হাতে থাকা ১০০ টাকার নোট ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। অন্য দিকে, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার স্পষ্ট আশ্বাস দিতে পারছে না কেন্দ্র। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, সপ্তাহ দুই-তিন লাগবে দেশের প্রায় দু’লক্ষ এটিএম-কে নতুন ব্যবস্থার উপযুক্ত করে তুলতে। কারণ, তার জন্য যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার দুইই পাল্টানো জরুরি। সব মিলিয়ে, সপ্তাহান্তে উদ্বেগ কমা দূরস্থান, বরং তা বহু গুণ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। রাস্তা-ঘাট, দোকান-বাজার থেকে শুরু করে সর্বত্র দুই মাথা এক হলেই অবধারিত জিজ্ঞাসা, ‘‘টাকা পেলেন?’’

আসলে লোকে দেখছেন ব্যাঙ্ক খোলার পরে তিন দিন ইতিমধ্যেই পার। পকেট আর আলমারি প্রায় খালি। এটিএম কার্যত অচল। সমস্যার সুরাহা হওয়ার লক্ষণ নেই। সোমবার আবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। তা হলে উপায়? এই উদ্বেগ থেকে টুকরো গণ্ডগোলও বেঁধেছে এখানে-ওখানে।

নাড়ি টিপেই সম্ভবত এ দিন জাপানের মাটি থেকে মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বলেছেন, ‘‘চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ কষ্টভোগ করছেন। অপেক্ষা শেষে দেখছেন এটিএম বন্ধ। এটিই উজ্জ্বল দেশের নিদর্শন। ২০১১-র সুনামির পর জাপানের ফুকুশিমার মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। তাঁদের মতোই দেশের স্বার্থে এত কষ্ট মাথা পেতে নিয়েছেন ভারতবাসী।’’ কষ্ট যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁরা কথাটা মানবেন কি না, সেটা অবশ্য অন্য প্রশ্ন, বলছেন অনেকেই।

শনিবার অধিকাংশ এটিএমের দরজাতেই নোটিস—‘নো ক্যাশ’ (টাকা নেই)। তা সত্ত্বেও অনেক জায়গায় কাগজ পেতে লাইন রাখার দৃশ্য চোখে পড়েছে। যদি টাকা আসে! কোথাও ব্যাঙ্কের দরজায় কেক-বিস্কুট সঙ্গে করে সকাল থেকে অপেক্ষা। কিন্তু সবুরে মেওয়া এ দিন অন্তত ফলেনি অনেকের কপালেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনেক বিপণিতে বাড়তি চাপে সার্ভার বসে যাওয়ার কারণে টাকা মেটানো যাচ্ছে না ক্রেডিট কার্ডেও। ক্রেতারা রুটি, ডিম, মাখন, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে না পেরে খালি হাতে বেরোতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিভিন্ন ব্যাঙ্কে খবর নিয়ে জানা গিয়েছে, দুপুর দু’টো পর্যন্ত টাকার জোগান তারা প্রায় পায়নি। ফলে গতকাল এটিএমের পরে এ দিন কাউন্টারেও সে ভাবে দেখা মেলেনি নতুন ২০০০ ও ৫০০ কিংবা পুরনো ১০০ টাকার নোটের। সন্ধ্যা নাগাদ কিছু এটিএমে টাকা ভরার খবর মিলেছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা নস্যি। অনেকে একাধিক কার্ড পরপর ব্যবহার করে টাকা তুলতে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও বিগড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অবশ্য দাবি, তাদের দিক থেকে খামতি নেই। যে পরিমাণ টাকা ব্যাঙ্কগুলিকে দেওয়ার কথা, তা তারা জুগিয়েছে। কিন্তু তা হলে নোটের জন্য এই হাহাকার কেন?

এ দিন জেটলি জানিয়েছেন, সারা দেশে মোট টাকার যা মূল্য, তার ৮৬ শতাংশই ছিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। তার মানে, ১০০ টাকার নোটের ভাগ ১৪ শতাংশেরও কম। নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট এখনও সে ভাবে বাজারে আসেনি। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, তবে কি ১৪ শতাংশেরও কম ১০০ টাকার নোটে ভরসা করেই বৈতরণী পার হওয়ার কথা ভেবেছিল সরকার? পরিস্থিতি সামাল দিতে ১০০ টাকার নোটের জোগান যথেষ্ট বাড়ানোর কথা আগে ভাবা হল না কেন?

শুধু তা-ই নয়, এত দিন দোকান সাধারণত হাজার টাকার নোটের খুচরো দিত পাঁচশো-একশোর নোট মিলিয়ে। এখন ৫০০ টাকার নোট বাজারে নেই। আর একশোর নোট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে বহু কষ্টে পাওয়া দু’হাজারের নতুন নোটই বা মানুষ ভাঙাবেন কী ভাবে? দক্ষিণ কলকাতায় ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দেওয়া প্রবীণ বলছিলেন, ‘‘সরকারের বোঝা উচিত ছিল যে, ঘরে থাকা টাকা তা-ও দু’দিন পরে জমা দিলে চলে। কিন্তু প্রয়োজন সময়ের অপেক্ষা করে না।’’ তাঁর টিপ্পনি, ‘‘আজ দুপুরের ভাত এক সপ্তাহ পরে এটিএমে টাকা এলে খাব বললে শরীর শুনবে কি?’’

জেটলি বলেছেন, ‘‘নতুন দুই নোটের আকার আলাদা। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যই এটিএমগুলিকে আগেভাগে নতুন নোটের উপযোগী করে তোলা যায়নি।’’ গতকাল ব্যাঙ্ক সূত্রেও জানা গিয়েছিল, এটিএমে টাকা রাখার জন্য ট্রে বা চ্যানেলের মতো দেখতে যে ক্যাসেট থাকে, সেগুলি মূলত পুরনো ৫০০-১০০০ এবং ১০০ টাকার নোটের উপযুক্ত মাপে তৈরি। তাই এটিএম চালু করার আগে ক্যাসেট বদলানো জরুরি। এই অল্প সময়ে তা করা সম্ভব হয়নি। সঙ্গে রয়েছে সফটওয়্যার পাল্টানোর ঝক্কি। মূলত সেই কারণেই এটিএম পরিষেবা পুরোপুরি ঠিক করতে দু’তিন সপ্তাহ সময় লাগার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।

কিন্তু আমজনতা অত যুক্তিতক্কো বোঝেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন, দু’টো দিন যাক। বাজারে নতুন নোট ঢুকতে শুরু করলে আপনিই কিছুটা স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি। কিন্তু সেই আশা মেটেনি। বরং এই হাল্কা ঠান্ডাতেও অনেকের কপালে ঘাম এনে ব্যাঙ্ককর্তারা বলেছেন,

‘‘টাকা তো আমাদের কাছে আসেনি।’’

এ রাজ্যে সাধারণ মানুষ ধৈর্যের পরীক্ষায় মোটের উপর পাশ করলেও, খুচরো গণ্ডগোলের কিছু খবর এসেছে। কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও টাকা না পাওয়ায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ। কোথাও তাঁরা হাতাহাতিতে জড়িয়েছেন ব্যাঙ্কের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে। এক জায়গায় ভিড়ের চাপে ভেঙে গিয়েছে এটিএমের কাচের দরজা। কলকাতার দু’জায়গায় পথ অবরোধেরও খবর মিলেছে। অনেকেই বলছেন, ‘‘টাকা জমা দিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে রাজি আছি। কিন্তু সংসার চালাতে আগে দু’হাজার করে দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। নিদেনপক্ষে প্রতিশ্রুতিমতো টাকা দেওয়া হোক ব্যাঙ্কের শাখাগুলি থেকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দাবি, নোট ছাপানোর সব ক’টি মেশিন কাজ করছে পুরোদমে। কিন্তু টাঁকশালে উঁকি মারার সুযোগ তো আর সাধারণ মানুষের নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।

জেটলি এ দিন বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, কত বিশাল এই কর্মকাণ্ড। জানান, নোট বাতিলের পর থেকে এ দিন দুপুর ১২টা ১৫ পর্যন্ত শুধু স্টেট ব্যাঙ্কেই লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ২৮ লক্ষটি। টাকা তুলেছেন ৩৮ লক্ষ জন। পুরনো নোট বদলানো মানুষের সংখ্যা ৫৮ লক্ষ। এটিএম ব্যবহার করেছেন ২২ লক্ষ মানুষ। মোট লেনদেন হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু দিনের শেষে দিল্লির প্রাণকেন্দ্র পার্লামেন্ট স্ট্রিট থেকে কলকাতার পাতিপুকুর— সর্বত্র ছবি সেই একই। হয় এটিএমে টাকা আসেনি, নয়তো শেষ হয়ে গিয়েছে নিমেষে। ব্যাঙ্কের শাখাও বলে দিয়েছে, ‘টাকা নেই।’

নাই নোট নাই

ভোগান্তির বারবেলা

• বহু এটিএম বন্ধ, যেগুলো খুলল, নিমেষে ফুরোলো টাকা

• দুপুরে অনেক ব্যাঙ্ক জানাল, টাকা শেষ, তোলা যাবে না, বদলও হবে না

• ক্ষোভে হাতাহাতি, ভাঙচুর, পথ অবরোধ

দুর্ভোগের কারণ

• গত দু’দিনের তুলনায় শনিবার ভিড় বেশি

• বহু ব্যাঙ্কে শনিবার নগদ এসে পৌঁছয়নি

• শুধু ১০০-র নোটে চাহিদা মেটাতে পারছে না এটিএম

অনেকে বলছেন, খাস মহানগরগুলিতে যদি এই হাল হয়, তবে একটু পিছিয়ে থাকা মফসস্‌ল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের কী দশা! দেশের ১৬ লক্ষেরও বেশি গ্রামের মধ্যে ব্যাঙ্ক পৌঁছেছে টেনেটুনে সাড়ে ছয় লক্ষে। বাড়ির কাছে ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়ে টাকা না পেয়ে যদি এত বিরক্তি হয়, তবে দশ কিলোমিটার সাইকেলে আসা লোকটির ফিরে যেতে ঠিক কেমন লাগে? উত্তর-পূর্ব ভারতে এই সমস্যা আরও প্রকট।

আমজনতার চাপা উষ্মা যাতে লাগামছাড়া অসন্তোষের চেহারা না নেয়, সম্ভবত তাই এ দিন সংবাদমাধ্যম মারফত পরিস্থিতি বোঝাতে চেয়েছেন জেটলি। মোদীর মতোই বলেছেন, সাধারণ মানুষের কষ্ট তাঁরা বুঝছেন। যদিও চা বাগানের শ্রমিকদের প্রায় খেতে না-পাওয়ার দশা শুনে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, একশো দিনের কাজের কর্মীদের জন্য যদি অ্যাকাউন্ট থাকে, তা চা-বাগান কর্মীদের নেই কেন? উল্লেখ্য, পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোটে বেতন পেয়েও অসুবিধায় পড়েছেন তাঁদের অনেকে।

এটিএমে টাকা আসতে পারে, শুধু এই খবরেই সন্ধ্যা নাগাদ লম্বা লাইন মধ্য কলকাতার এক এটিএমে। সেখানে জেটলির কথা পাড়তেই অনেকে বললেন, ‘‘ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়লে মানুষ একটু ভরসা পেত। কিন্তু ব্যাঙ্ক খোলার পরে প্রথম দিন (বৃহস্পতিবার) ব্যাঙ্কে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হল। শুক্রবার খালি হাতে ফেরাল এটিএম। আর শনিবার টাকা নেই দু’জায়গাতেই!’’

এ দিন মোদী বলেছেন, ‘‘১-২-৫ লক্ষ লোক পাপ করেছেন হয়তো। আগে গঙ্গায় সিকি ফেলতেন। এখন নোট ফেলছেন।... আমি তো নানা দিক থেকে আশীর্বাদ পাচ্ছি।’’ সে কথা তুলতেই এক মধ্যবয়স্কের মন্তব্য, ‘‘কালো টাকা নিয়ে গেরোয় পড়া প্রোমোটারের মুখ কালো করে ঘোরা দেখতে মন্দ লাগছে না। কিন্তু নিজের পকেট গড়ের মাঠ হলে চলবে কি?’’

কেন্দ্র থেকে ব্যাঙ্ক— সবাই আমজনতাকে ধৈর্য ধরতে বলছে। এ দিন ব্যাঙ্কের লাইনে এক বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘এত দিন ধরে লোককে এটিএম-এ অভ্যেস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন হঠাৎ তাঁদের ব্যাঙ্কের কাউন্টারে পাঠালে চলবে কেন?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bank notes bank problems
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE