Advertisement
১৬ মে ২০২৪

যন্ত্র চায় আঙুলের ছাপ, রেশন বন্ধ কুষ্ঠরোগীদের

ওঁদের আঙুল খসে গিয়েছে কবেই। কারও আঙুল থাকলেও সে আঙুলে ‘ছাপ’ পড়ে না। ওঁরা কুষ্ঠ-আক্রান্ত। পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েছেন বহুদিন। সমাজও মুখ ঘুরিয়েই রেখেছে। এ বার নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব কেড়ে নিচ্ছে মুখের গ্রাসটাও।

ইন্দিরানগরীর কুষ্ঠরোগীদের কয়েক জন। —নিজস্ব চিত্র

ইন্দিরানগরীর কুষ্ঠরোগীদের কয়েক জন। —নিজস্ব চিত্র

আর্যভট্ট খান
রাঁচি শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

ওঁদের আঙুল খসে গিয়েছে কবেই। কারও আঙুল থাকলেও সে আঙুলে ‘ছাপ’ পড়ে না। ওঁরা কুষ্ঠ-আক্রান্ত।

পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েছেন বহুদিন। সমাজও মুখ ঘুরিয়েই রেখেছে। এ বার নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব কেড়ে নিচ্ছে মুখের গ্রাসটাও।

কী রকম? সরকারি রেশনের যে সাহায্য ওঁরা পেতেন, রেশন ব্যবস্থার ‘বায়োমেট্রিক সিস্টেম’-এর আগমনে তা বন্ধ হওয়ার মুখে। বায়োমেট্রিক সিস্টেম তো মুখ বোঝে না, চায় আঙুলের ছাপ! কুষ্ঠরোগীর আঙুলই যে অকেজো!

রাঁচির জগন্নাথপুরের কাছে ইন্দিরানগরীর একপাশে রয়েছে ‘কুষ্ঠ কলোনি’। এখানেই কুষ্ঠরোগীদের সরকারি পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। রয়েছে ১৪০টি ঘর। এই ১৪০ ঘরের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন একাই থাকেন। গত তিন মাস ধরে তাঁরা সরকারি রেশন পাচ্ছেন না। রাঁচি-সহ ঝাড়খণ্ডের বেশ কয়েকটি জেলায় এখন রেশন পেতে গেলে রেশন কার্ড দেখানোর পাশাপাশি আঙুলের বায়োমেট্রিক ছাপ দেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে। আর গোল বেধেছে সেখানেই।

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চন্দাদেবী স্বীকার করছেন, ‘‘খুব কষ্টে ওঁরা দিন কাটাচ্ছেন। আমরা রেশন ডিলারকে বলেছি, ওঁদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতি থেকে ছাড় দিতে। কিন্তু রেশন ডিলার পরিষ্কার জানিয়েছেন, সরকারি নিয়মের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। এলাকার বিধায়ক থেকে শুরু করে খাদ্যমন্ত্রী সরযূ রায়কেও আমরা লিখিত ভাবে বিষয়টা জানিয়েছি।’’

কুষ্ঠ কলোনির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব গণেশ লাল একাই থাকেন। গুমলার ঘাগরা ব্লকের বদ্রি গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। বাড়ি এখনও আছে, আছে পরিবার। কিন্তু তিনি বিতাড়িত হয়ে জুটেছেন এখানে। গণেশ বলেন, ‘‘গ্রামে পরিবারের সবাই আছে। কিন্তু রোগ হওয়ার পরে আমাকে সবাই একঘরে করে দেয়।’’ গুমলার বিধায়ক মারফত রাঁচির এই কুষ্ঠ কলোনির কথা জানতে পারেন গণেশ। নিজের রেশন কার্ড নিয়ে এখানে চলে আসেন। কাউন্সিলরের বদান্যতায় একটা মাথা গোঁজার আস্তানাও হয়। কিন্তু গত তিন মাস ধরে কোনও রেশন পাচ্ছেন না। ‘‘আসলে আমি তো আঙুলের ছাপ দিতে পারি না, তাই!’’

গণেশেরই পড়শি রাজারাম মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘যন্ত্রে আঙুলেছাপ দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে রেশনের চাল, গম, আটা আর তেলটুকুও পাব না? নিয়ম তো সরকারই করেছে। আমাদের কথা ভেবে সেই নিয়ম পাল্টাক!’’

রেশন দোকানে কী ভাবে কাজ করে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি? রেশন ডিলাররা জানালেন, নিয়ম অনুযায়ী রেশন কার্ড এবং আধার কার্ড ‘লিঙ্ক’ করে দেওয়ার কথা। অর্থাৎ আধার কার্ডে যে আঙুলের ছাপ আছে, রেশন দোকানের বায়োমেট্রিক যন্ত্রে সেই আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখে নিয়ে হয়। কুষ্ঠরোগীদের ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি মানতে গিয়েই নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। এঁদের বেশির ভাগেরই আধার কার্ড রয়েছে। কিন্তু আধার কার্ড হওয়ার সময় হয়তো যে আঙুলে ছাপ দিতে পেরেছিলেন, এখন সেই আঙুলটি খসে গিয়েছে বা অসাড় হয়ে গিয়েছে। ফলে দু’টি ছাপ মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে না। অনেকের এতই খারাপ অবস্থা, নতুন করে ছাপ দিতেও পারছেন না। কারও কারও ক্ষেত্রে আধার কার্ড তৈরির সময়েই তাঁদের আঙুল খসে গিয়েছিল। ফলে আধার কার্ডে তাঁদের চোখের মণির ছবি রয়েছে। কিন্তু রেশন দোকানের বায়োমেট্রিক যন্ত্রে সে উপায় নেই। ফলে সমস্যা মিটছে না।

কলোনির কয়েকটি ঘরে সপরিবারও থাকেন কয়েক জন। তাঁদের ক্ষেত্রে ঝামেলাটা কম। মধু মাহাতোর কথায়, ‘‘আমার ও আমার স্ত্রীর কুষ্ঠ। কিন্তু আমার ছেলের এই রোগ নেই। ও-ই আঙুলের ছাপ দিয়ে রেশন তোলে। কিন্তু এখানে বেশির ভাগই তো প্রায় একাই থাকেন।’’

ঝাড়খণ্ডের খাদ্যমন্ত্রী সরযূ রায় সমস্যাটির কথা শুনেছেন। বললেন, ‘‘রেশন নিয়ে দুর্নীতি রোধ করতেই বায়োমেট্রিক ছাপ চালু করা হয়েছিল।’’ কিন্তু সে ক্ষেত্রে কুষ্ঠরোগীরা কী করবেন? সরযূ আশ্বাস দিলেন, ‘‘কুষ্ঠ কলোনির বাসিন্দাদের বায়োমেট্রিক ছাড়ের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Leprosy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE