Advertisement
১৭ মে ২০২৪
ভারসাম্য/১

ওয়ার রুম থেকে মোদী দলের মঞ্চে

প্রেমপত্র নয়, পাকিস্তানকে জবাব দিতে হবে তাদের ভাষাতেই। পাকিস্তান বারবার আমাদের সেনাদের হত্যা করছে। কিন্তু কেন্দ্র পদক্ষেপ করছে না। কথাগুলি নরেন্দ্র মোদীর।

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
কোঝিকোড় শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৭
Share: Save:

প্রেমপত্র নয়, পাকিস্তানকে জবাব দিতে হবে তাদের ভাষাতেই। পাকিস্তান বারবার আমাদের সেনাদের হত্যা করছে। কিন্তু কেন্দ্র পদক্ষেপ করছে না।

কথাগুলি নরেন্দ্র মোদীর।

ফারাক একটাই। এ সব কথা বলার সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেননি।

আর এখন? উরির ঘটনার পর নিজের সঙ্গেই লড়াই করতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে। খোদ বিজেপি আর সঙ্ঘের থেকেই প্রশ্ন উঠছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে। পদক্ষেপ কোথায়?

উরির ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পৌঁছে গিয়েছিলেন ওয়ার রুমে। দিল্লির সাউথ ব্লকের এই বিশেষ ঘরটি যুদ্ধ বা ওই ধরনের পরিস্থিতিতেই ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানকে সামরিক জবাব দেওয়া যায় কী ভাবে, তা নিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা আলোচনাও করেছেন তিনি। সেখানে তিন সেনাপ্রধান ছাড়াও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি ঘাঁটিগুলির অবস্থান, এগুলিতে আঘাত করতে ভারত কী ব্যবস্থা নিতে পারে, সে সব নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।

অনেকেই মনে করছেন, ওয়ার রুমে মোদীর পৌঁছনো দলের সামনে একটা বার্তা। কেননা, ক্ষমতায় এসে মোদীর সামনে চ্যালেঞ্জ তাঁর পুরনো কথাগুলিই। বিরোধী দলের নেতা থেকে আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি যে বদলাননি, একই ভাবে কঠোর পদক্ষেপ করার কথা ভাবতে পারেন, সেটা বোঝানোই উদ্দেশ্য। কেননা, সেই গোপন আলোচনার পরেও বেশ কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নিছক কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো ছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির কোনও পদক্ষেপের দেখা মেলেনি। আর এই পরিস্থিতিতেই আগামী পরশু কেরলের কোঝিকোড়ে প্রধানমন্ত্রীকে হাজির হতে হচ্ছে গোটা দেশ থেকে আসা দলের প্রায় তিন হাজার নেতার সামনে। বিজেপির জাতীয় পরিষদের বৈঠকের সেই প্রকাশ্য মঞ্চে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের জন্য দাবি তীব্র হবে। তবে ওই মঞ্চ মোদী থেকে কী বার্তা দেন, তার অপেক্ষায় রয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তবে একই সঙ্গে প্রমাদ গুনছেন তাঁরা। কারণ, দলের নিয়ম অনুসারে সেখানে প্রবেশাধিকার রয়েছে সংবাদ মাধ্যমেরও। তাই দলের অনেকেই মনে করছেন, মোদীকে এখানে ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখেই মুখ খুলতে হবে। পাকিস্তানকে নিয়ে তেতে থাকা দলের নেতা-কর্মীদের সামনে বলতে গিয়ে মাথায় রাখতে হবে আন্তর্জাতিক সমীকরণকেও।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্কটের কথা বুঝেই আজ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পৌঁছেছেন এখানে। কাল রাতে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, একসময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিরন্তর তাতিয়ে দিতেন নরেন্দ্র মোদী। ভোট প্রচারে হাততালিও জুটত। লোকসভায় তার প্রতিফলন ভোটবাক্সেও পড়েছে। সামনে এ বার উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচন। দলের এবং সঙ্ঘ পরিবারের অনেকেই চান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করে জাতীয়তাবাদের হাওয়া আরও উচ্চগ্রামে নিয়ে যান মোদী। কিন্তু বিরোধী দলে থেকে বলা আর কুর্সিতে বসে দায়িত্ব পালনের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই এই জাঁতাকলে পড়ে এখন ভারসাম্যের পথ খুঁজতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে। তিনিই গোটা দলের মুখ, আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীও বটে। তাই দলের স্বার্থ মাথায় রেখেও হুট করে কিছু বলা বা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

এই পরিস্থিতিতে অমিত শাহ মুশকিল আসানের ভূমিকায় নেমে দলের নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন, জাতীয় পরিষদের বৈঠকে পাকিস্তান ও সন্ত্রাস ছড়াতে তাদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী যা বলার বলবেন। কিন্তু দলের নেতারা যদি আম-জনতার ভাবনা ও অসন্তোষকে মাথায় রেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে চান, তার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু কোনও ভাবেই সেটি যেন প্রধানমন্ত্রীর উপরে অনাস্থা প্রকাশের পর্যায়ে না পৌঁছয়। বৈঠকে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে, সেখানেও কঠোর ভাষায় পাকিস্তানের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হবে। অনেকেই মনে করছেন, উরির ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রীর ওয়ার রুমে পৌঁছে যাওয়া দেশ ও দলের সামনে অন্য বার্তা দিচ্ছে। মোদী বোঝাতে চেয়েছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ করার দিকটিও ভেবে দেখছেন তিনি। কোনও ভাবেই পিছিয়ে আসছেন না।

উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবের ভোটের দিকে তাকিয়ে আমজনতার স্বার্থে সরকারের পদক্ষেপ ও তার প্রচারের কৌশল নিয়েই আলোচনার কথা ছিল বিজেপির বৈঠকে। কিন্তু এখন সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে উরি প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী এই পরিস্থিতিতেও কোঝিকোড়ে আসছেন বলে তাঁর কাজের সুবিধার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সাউথ ব্লককেই যেন তুলে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে যাতে এখান থেকেই সব কাজ পরিচালনা করতে পারেন মোদী, সেই বন্দোবস্ত হয়েছে। আর কোঝিকোড়ে বিজেপির বৈঠকের আলোচনাও এগোতে চলেছে পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। অমিত শাহ দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর জমানায় সন্ত্রাসবাদের চিহ্ন থাকবে না। তবে তার পরেও মোদীর উপর চাপ বাড়াতে সঙ্ঘের নেতা ইন্দ্রেশ কুমার থেকে শুরু করে বিজেপির প্রাক্তন নেতা যশবন্ত সিন্হা এখন প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের কঠোর পদক্ষেপ করা উচিত। গত কয়েক দিন সংযম দেখিয়ে সঙ্ঘের নেতারা এখন পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে কব্জা করার দাবিও তুলতে শুরু করেছেন। দল ও সঙ্ঘের এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা রাম মাধব উরির ঘটনার দিনেই ‘দাঁতের বদলে চোয়াল’ খুলে নেওয়ার দাবি তুলে বসেন। বিজেপি নেতা চন্দন মিত্রও বলেন, প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে। চাপ বাড়লেও দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ করতে গেলে যে ঝক্কি, সেটি বিলক্ষণ জানেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। যে কোনও সময়ে তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আকা র নিতে পারে। সে পথে এগোতে চাইলে আন্তর্জাতিক মহল চাপে ফেলবে ভারতকে। তাই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক পথে পাকিস্তানকে একঘরে করতে চাইছেন। সেই বাস্তবতা দলের কর্মীদের বোঝাতে পারেন কি না, সেটাই এখন মোদীর পরীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi War Room Uri attack Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE