হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্বের ভরসা জাগিয়ে যে ‘কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে বরাকের ১৬টি আসনের মধ্যে আটটি জিতে নিয়েছে বিজেপি, সেই বিজ্ঞপ্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, আগামী সপ্তাহেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার জন্য আসতে চলেছে ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল’। বিজেপির জোট শরিক অগপ তো বরাবরই ওই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে ছিল। এ বার ছাত্র সংগঠন আসু এবং কৃষকমুক্তি সংগ্রাম সমিতিও কেন্দ্রের ওই বিজ্ঞপ্তি ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরোধিতা করে মাঠে নামছে।
গত বছর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল: ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করা পড়শি দেশের সংখ্যালঘু (হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি) ব্যক্তিরা এ দেশে থাকার অধিকার পাবেন। পরে বিজেপি জানায়, মানবিকতার খাতিরে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথাও ভাবা হবে। ওই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে তখন থেকেই আসু, সংগ্রাম সমিতি, অগপ প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে কংগ্রেস ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। দাবি করে, শুধু বিজ্ঞপ্তির কোনও আইনগত ভিত্তি নেই। এ নিয়ে আইন প্রণয়ন করুক বা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করুক কেন্দ্র। কিন্তু তা এখনও করা হয়নি। ফলে বিদেশি সন্দেহে হিন্দুদের ধরপাকড় ও ডিটেনশন শিবিরে বন্দি করার কাজ এখনও চলছে। পুলিশের সাফ কথা, বিদেশি সন্দেহে হিন্দুদের ধরা যাবে না—তেমন কোনও আইন বা সরকারি নির্দেশ তাদের কাছে নেই।
স্থানীয় ভাবে বিজেপি নেতারা দাবি করছেন, শীঘ্রই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বিলটি আনবে। কিন্তু জোট শরিক অগপ তার তীব্র বিরোধিতা করছে। এই বিষয়টি নিয়ে জোট গড়ার আগে, জোট গড়ায় সময় এবং জোট গড়ে সরকার গড়ার পরেও দুই দলের মতানৈক্য কাটেনি। তার উপর, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে উজানি অসমে বিজেপি নেতা হিমন্তবিশ্ব শর্মা ঘোষণা করেছেন ১৯৭১ নয়, ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করে বিদেশি বহিষ্কার করবে বিজেপি। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা অধিবেশনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও বিজেপির নীতির সমালোচনা করে বলেন, একদিকে তারা ২০১৪ সাল নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করছে, অন্য দিকে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করবে বলছে। বিজেপির দুমুখো নীতিতে মানুষ বিভ্রান্ত।
কিন্তু ঠিক কবে আনা হবে হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব নিয়ে বিল, কী ভাবে আসু-অগপর আপত্তি অগ্রাহ্য করে এগোবে বিজেপি—তা নিয়ে এখনও স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। তিনি শুধু বলেন, ‘‘বিদেশিমুক্ত অসম গড়বই। কিন্তু কোনও ভাবে প্রকৃত ভারতীয়দের হয়রান করা হবে না।’’ উল্লেখ্য, এই সর্বানন্দই অগপতে থাকার সময় আইএমডিটি আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ে আইন প্রত্যাহার করিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন অসমের ‘জাতীয় নায়ক’-এর খেতাব। এখন তিনিই যদি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হয়ে অসম চুক্তির বিরুদ্ধে কাজ করেন তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।
আসুর সভাপতি দীপাঙ্ককুমার নাথ ও সাধারণ সম্পাদক লুরিণজ্যোতি গগৈ জানান, ১৯৭১ সালের পরে অসমে আসা মুসলিম বা হিন্দু—কারও বোঝাই অসম নেবে না। অসমের মতো ছোট, দরিদ্র রাজ্যের এত অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভার নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। সুপ্রিম কোর্টও অসম চুক্তির ভিত্তিতেই বিদেশি বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, বিজেপি অসম চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার দিয়েছে। আসু এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও তাদের স্পষ্ট মতামত জানিয়ে এসেছে। অসু মনে করে, এর পরেও সংশোধিত আইনে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হলে তা কোনও ভাবেই মানা হবে না। একই মত অসম জাতীয়তাবাদী যুব ছাত্র পরিষদেরও। একই ভাবে কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি এ দিন অখিল গগৈয়ের নেতৃত্বে গুয়াহাটির দিঘলীপুখুরির ধারে একটি প্রতিবাদ সভা করে। সেখানে বলা হয়, কোনও ভাবেই ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতে আসা বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়া চলবে না।
পাশাপাশি, উত্তর-পূর্ব ছাত্র সংগঠন ‘নেসো’ দাবি তুলেছে, শুধু অসম নয়, বিদেশি বহিষ্কারের জন্য উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যেই নাগরিক পঞ্জি তৈরি ও উন্নীতকরণের কাজ শুরু করা হোক। কারণ অসম ও মেঘালয় সীমান্ত পার হয়ে এ দেশে ঢোকা বাংলাদেশিরা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মণিপুর, নাগাল্যান্ডেও দিনমজুর হিসেবে কাজ করছে বহু বাংলাদেশি। নেসোর সভাপতি স্যামুয়েল জারওয়া বলেন, ‘‘১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জী এখন অচল। গোটা উত্তর-পূর্ব অবৈধ অনুপ্রবেশ সমস্যায় জর্জরিত। বিদেশি বিতাড়নে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’’
এ দিকে, সর্বানন্দ সোনোয়াল গত কাল রাজ্যের বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতে ঝুলে থাকা প্রায় ২ লক্ষ ৬২ হাজার মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সোনোয়াল, মুখ্যসচিব ভি কে পিপারসেনিয়া, স্বরাষ্ট্র সচিব এল এস চাংসাংন, নাগরিকপঞ্জীর ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্র কমিশনার প্রতীক হাজেলা ও ডিজিপি মুকেশ সহায় বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতের বিচারকদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন।
বৈঠকে রাজ্যে থাকা ডাউটফুল বা ডি-ভোটারের প্রকৃত সংখ্যা দিতে পারেনি স্বরাষ্ট্র দফতর। তাতে ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। গত বছর বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতের সংখ্যা ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হলেও অভিযোগ, বিচারক ও কর্মীরা নিয়ম মতো বেতন পান না। জেলাশাসকের দফতরে নিয়মিত গিয়ে আদালত চালানোর খরচ যোগাড় করতে হয়। আদালতগুলির পরিকাঠামোর দিকে নজর দেওয়া হয় না। বিভিন্ন সমস্যার কথা জেনে সর্বানন্দ বলেন, আদলতগুলির সমস্যার কথা জেনেছি। আদালতগুলি যাতে কোনও সমস্যা ছাড়াই ঝুলে থাকা মামলাগুলির দ্রুত বিচার শেষ করতে পারে, তার জন্য যা করার সরকার করবে। তিনি জানান, বরাক বা ব্রহ্মপুত্রের সমতল, পাহাড় বা চা বাগানে থাকা প্রকৃত ভারতীয়দের যাতে বিদেশি সন্দেহে হেনস্থা না হতে হয় সে বিষয়ে তিনি সব বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy