Advertisement
০৭ মে ২০২৪

দলের সঙ্কট কাটানোই চ্যালেঞ্জ সীতার

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রবীণ নেতাদের অনেকে তাঁকে ‘উত্তমকুমার’ বলে ডাকেন। আজ আলিমুদ্দিনের সমর্থনের জোরেই সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক হলেন সেই ‘উত্তমকুমার’— সীতারাম ইয়েচুরি। রাজ্যের নেতাদের প্রিয়পাত্র ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ থেকেই রাজ্যসভার সাংসদ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুদের প্রচেষ্টায় আজ দলের শীর্ষ পদে এ হেন ইয়েচুরির উত্থান হল ঠিকই।

পার্টি কংগ্রেস শেষে সমুদ্রবক্ষে লাল পতাকার মিছিল। বিশাখাপত্তনমের রামকৃষ্ণ বিচে।

পার্টি কংগ্রেস শেষে সমুদ্রবক্ষে লাল পতাকার মিছিল। বিশাখাপত্তনমের রামকৃষ্ণ বিচে।

সন্দীপন চক্রবর্তী, প্রেমাংশু চৌধুরী
বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রবীণ নেতাদের অনেকে তাঁকে ‘উত্তমকুমার’ বলে ডাকেন। আজ আলিমুদ্দিনের সমর্থনের জোরেই সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক হলেন সেই ‘উত্তমকুমার’— সীতারাম ইয়েচুরি। রাজ্যের নেতাদের প্রিয়পাত্র ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ থেকেই রাজ্যসভার সাংসদ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুদের প্রচেষ্টায় আজ দলের শীর্ষ পদে এ হেন ইয়েচুরির উত্থান হল ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠল, এতে পশ্চিমবঙ্গের কী লাভ হবে? ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তনের ফলে বাংলার মাটিতে কি সিপিএমের হাল শোধরাবে?

এমন দাবি অবশ্য আলিমুদ্দিনের নেতারা করছেন না। তাঁদের বক্তব্য, প্রকাশ কারাটের জায়গায় সীতারাম আসায় রাজ্যে সিপিএমের অবস্থা রাতারাতি বদলে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই। দলের হাল শোধরানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে আজ ইয়েচুরি নিজেও পশ্চিমবঙ্গের কঠিন পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘গত চার বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের পার্টি আক্রান্ত। শাসক দল ও প্রশাসন একজোট হয়ে হামলায় নেমেছে। শহিদের তালিকা দিন দিন বাড়ছে। এখন আমাদেরও একজোট হয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’

পরিস্থিতি যে কঠিন, তা অস্বীকার করছেন না রাজ্যের নেতারাও। ২০১১-য় ক্ষমতা হারানোর পরে এখনও সিপিএমের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। ভোটব্যাঙ্কে ধস নামছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা ৪২.৪৭% ভোট পান। গত লোকসভায় সেই ভোটের হার নেমে এসেছে ২৯.৬১ শতাংশে। সংগঠনের দুর্বলতাও প্রকট। যার সর্বশেষ প্রমাণ কলকাতার পুর-নির্বাচন। প্রতিরোধের ডাক দিয়েও তৃণমূলের সন্ত্রাসের মুখে কোনও বাধাই গড়ে তুলতে পারেনি সিপিএম তথা বামেরা। ইয়েচুরি কি প্রতিরোধের রাস্তা দেখাতে পারবেন?

সিপিএম নেতাদের যুক্তি, নতুন সাধারণ সম্পাদক এলেন এবং রাস্তায় নেমে তৃণমূলের সন্ত্রাস আটকে দিলেন— এমনটা হয় না। নতুন করে দলের সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তুলেই তৃণমূলের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এখন থেকে অন্তত সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে রাজ্যের নেতাদের চিন্তাভাবনার মিল বেশি হবে। এত দিন কারাটের জমানায় বারেবারেই এ কে গোপালন ভবনের সঙ্গে আলিমুদ্দিনের বিরোধ বেধেছে। সেই টানাপড়েনে ইয়েচুরিকে পাশে পেয়েছেন বিমান-বুদ্ধ। বিশেষ করে পরমাণু চুক্তিতে ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কারাট তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ তুলেছিল আলিমুদ্দিন, ইয়েচুরি সে বিষয়েও তাঁদের পাশে ছিলেন। এখন ইয়েচুরি শীর্ষে আসায় রাজ্যের নেতারা আশা করছেন, এ কে গোপালন ভবন এবং আলিমুদ্দিনের সমন্বয় বাড়বে। ইয়েচুরি জাতীয় স্তরে এমন কোনও নীতি নেবেন না, যাতে রাজ্য স্তরে সূর্যকান্ত মিশ্র সমস্যায় পড়েন।

সিপিএম নেতাদের দাবি, গত কয়েক মাসে দলের সক্রিয়তা বেড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন গড়ে তোলা গিয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর বাকি। ধাপে ধাপে দলের সক্রিয়তা আরও বাড়ানো হবে। ২৫ এপ্রিল পুরসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ মিটে যাওয়ার পর তৃণমূলের সন্ত্রাস-রিগিংয়ের প্রতিবাদে বাংলা বন্‌ধের ডাক দিচ্ছে বামফ্রন্ট। মমতা-সরকারের চার বছরে এই প্রথম। রাজ্য নেতারা চাইছেন, খুব তাড়াতাড়ি ইয়েচুরিকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। নতুন সাধারণ সম্পাদকের ডাকে দলের কর্মী, বিশেষত তরুণরা উজ্জীবিত হবেন বলেই আশা আলিমুদ্দিনের।

যুযুধান নন, পাশাপাশি। সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে এস আর পিল্লাই। বিশাখাপত্তনমে।

এই একই উদ্দেশ্য নিয়ে এ বার পশ্চিমবঙ্গ থেকে মহম্মদ সেলিমকেও পলিটব্যুরোয় আনা হয়েছে। বিমান-সূর্য পলিটব্যুরোয় থাকছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব ও নিরুপম সেন অসুস্থতার জন্য পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকতে চাননি। দু’জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে রাখা হয়েছে। তাঁদেরই পরবর্তী স্তরের নেতা সেলিম পলিটব্যুরোয় এসেছেন। সেলিম বলেন, ‘‘বাংলা-সহ গোটা দেশেই দলকে চাঙ্গা করতে এমন নেতৃত্ব বাছাই করা হয়েছে, যাঁরা দেশের যে কোনও জায়গায় দরকার পড়লেই পৌঁছে যেতে পারেন। আবার মানসিক ভাবেও তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে পারবেন।’’ সেলিম লোকসভার সাংসদ হলেও সেখানে কেরলের নেতাদের আধিপত্য বলে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছিলেন না। পলিটব্যুরোয় নিয়ে এসে তাঁকে গুরুত্বও দেওয়া হল।

আর এক বাঙালি নেতা, বর্তমানে কৃষক সভার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লাও এ বার পলিটব্যুরোয় জায়গা করে নিলেন। রাজস্থানের দায়িত্ব নিয়ে মরুরাজ্যে দলের শক্তি বাড়িয়েছিলেন তিনি। এখন দিল্লিতে কাজ করলেও বাংলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। হান্নানও পশ্চিমবঙ্গে কৃষক সভার কাজে আরও গুরুত্ব দিতে চাইছেন। হান্নান এ দিন বলেন, ‘‘কৃষকদের আন্দোলনের জোরেই বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। কৃষকদের স্বার্থে কাজও করেছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট জমানার শেষ দশ বছরে কৃষক আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার নতুন করে জনসংযোগ তৈরি করছি। এত দিন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত মজুরদের আলাদা সংগঠন ছিল না। এ বার রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসে পশ্চিমবঙ্গে পৃথক ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন গড়ে তোলারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ পলিটব্যুরোয় আরেক নতুন মুখ সুভাষিণী আলি ‘কানপুরকা বেটি’ নামে পরিচিত হলেও গত লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তাঁর অন্য রকম সম্পর্কে গড়ে উঠেছে। বৃন্দা কারাটের পর দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে সিপিএমের পলিটব্যুরোয় আসার পরেই সুভাষিণী জানান, তিনি পুর-নির্বাচনের প্রচারে ভাটপাড়ায় যেতে চান। কেন? লক্ষ্মী সায়গলের মেয়ের জবাব, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে দলের উপর হামলা চলছে, তা মুখ বুজে মেনে নেওয়া যায় না। তৃণমূলের হামলার প্রতিরোধে গোটা দলকে পশ্চিমবঙ্গের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’

কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ বার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন মুখ হাওড়ার শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। শ্রীদীপ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য। প্রাক্তন লোকসভা সাংসদ, বীরভূমের নতুন জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোমও এ বার কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলেন। সমাজের নিম্ন বর্গ থেকে উঠে আসা রামচন্দ্রকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে এনে দল তাদেরও বার্তা দিয়েছে বলে সকলে মনে করছেন। মহিলা সংগঠনের দুই নেত্রী মিনতি ঘোষ এবং অঞ্জু করও কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন।

নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে প্রথম বক্তৃতায় ইয়েচুরি ইংরেজি, হিন্দির পাশাপাশি তেলুগুতেও ধন্যবাদ জানান নেতাদের। তখনই দাবি ওঠে, বাংলাতেও বলতে হবে। কারণ, ইংরেজি, হিন্দি বা মাতৃভাষা তেলুগু ছাড়া ভাঙা ভাঙা বাংলাও বলতে পারেন তিনি। দাবি শুনে হাসতে হাসতে ইয়েচুরি বলেন, ‘‘আর বাংলায় বলতে অনুরোধ করবেন না!’’ ইয়েচুরি জানেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে পার্টিকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখানোটাই তাঁর সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। আলিমুদ্দিনের নেতারা সাধারণ সম্পাদক পদের দৌড়ে আগাগোড়া তাঁর পাশে ছিলেন। এ বার তাঁকেও আলিমুদ্দিনের পাশে দাঁড়াতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে দলের শক্তি ফেরানোর কাজে হাত লাগাতে হবে।

আলিমুদ্দিনের প্রিয় ‘উত্তমকুমার’ সিপিএমের ‘হারানো সুর’ ফিরিয়ে দিতে পারেন কি না, এখন তারই পরীক্ষা!

— নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE