Advertisement
E-Paper

স্বামীর বাড়িটা কোথায়, হুঙ্কার দিল্লিতে

ঠিক করে সংখ্যাটা বলা সম্ভব নয়। তবু হাজার তিনেক তো হবেই! চব্বিশ আকবর রোডের সামনে একের পর এক বাস থেকে সব লাফিয়ে লাফিয়ে নামছেন! সবে তখন সকাল সওয়া দশটা। কমবেশি সকলেরই মাথায় সবুজ ফেট্টি। তাতে সাদা রঙে লেখা ‘রায়বরেলী সংসদীয় ক্ষেত্র’।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২০
জামিন পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন রাহুল-সনিয়া। আদালত চত্বর তত ক্ষণে ভিড়ে ঠাসা। কোর্টে হাজির ছিলেন প্রিয়ঙ্কাও। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ ও পিটিআই।

জামিন পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন রাহুল-সনিয়া। আদালত চত্বর তত ক্ষণে ভিড়ে ঠাসা। কোর্টে হাজির ছিলেন প্রিয়ঙ্কাও। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ ও পিটিআই।

ঠিক করে সংখ্যাটা বলা সম্ভব নয়। তবু হাজার তিনেক তো হবেই! চব্বিশ আকবর রোডের সামনে একের পর এক বাস থেকে সব লাফিয়ে লাফিয়ে নামছেন! সবে তখন সকাল সওয়া দশটা। কমবেশি সকলেরই মাথায় সবুজ ফেট্টি। তাতে সাদা রঙে লেখা ‘রায়বরেলী সংসদীয় ক্ষেত্র’। সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর নামে স্লোগান তুলতে তুলতে কিছুটা থিতু হয়েছে কি হয়নি, ভিড়ের মধ্যে থেকেই হঠাৎ আওয়াজ এল, ‘‘আরে স্বামীকা ঘর কাহা রে!’’ বুঝতে অসুবিধা হল না বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর কথাই বলছেন ওঁরা। অমনি সমস্বরে আওয়াজ উঠল, ‘‘পাতা করো তো পাতা করো, ওহি পে চলতে হ্যায়!’’

রায়বরেলী কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়ার নির্বাচন কেন্দ্র। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস সেখানে দেখভাল করেন কিশোরীলাল শর্মা। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় দলনেত্রীর যখন আদালতে ডাক পড়েছে, তখন কিশোরীলালই প্রতিবাদ জানাতে বাস ভর্তি করে রায়বরেলীর কর্মীদের নিয়ে এসেছেন। অথচ ‘স্বামীকা ঘর পাতা করো’ শুনে তাঁর মুখটাও যেন পাংশুটে হয়ে গেল! এরা বলে কী! শেষ পর্যন্ত বাবা-বাছা করে, প্রায় হাতে-পায়ে ধরে তাদের বিরত করে করা হল। তার পর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে বসানো হল কংগ্রেস দফতরের উঠোনে।

সনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধে ন্যাশনা হেরাল্ড মামলাকে কেন্দ্র করে আজ এমটাই ছিল কংগ্রেস কর্মীদের মেজাজ। স্বামীকে সামনে পেলে যেন সেখানেই হেস্তনেস্ত করে দেয়! তবে সুচিন্তিত ভাবেই সেই মেজাজটাকে কাজে লাগালেন, কিন্তু মাত্রা ছাড়াতে দিলেন না সনিয়ারা। বরং চিত্রনাট্য মেনে যুদ্ধের মেজাজ বেঁধে রাখা হল কংগ্রেস সদর দফতরের চৌহদ্দিতে। এর সঙ্গে কৌশলে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হিসেবে ব্যবহার করা হল সংবাদমাধ্যমকে।

কী রকম?

বস্তুত কংগ্রেসের মধ্যে রণং দেহি মনোভাবটা তৈরি করে দিয়েছিলেন সনিয়াই। মামলায় স্থগিতাদেশের আবেদন খারিজ করে উচ্চ আদালত কংগ্রেস সভানেত্রী ও সহসভাপতিকে এজলাসে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতেই ক’দিন আগে সনিয়া বলেছিলেন, ‘‘আমি ইন্দিরা গাঁধীর পুত্রবধূ। কাউকে ডরাই না।’’ সনিয়ার সেই মনোভাব আঁচ করে কংগ্রেস নেতারা স্থির করেছিলেন আজ দিল্লিতে হুলুস্থূল বাধাবেন। ১৯৭৭ সালে ঠিক যে ভাবে হেঁটে আদালতে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধী এ বারও তাই করা হবে। এমনকী, আজও কংগ্রেস দফতরে দাঁড়িয়ে দলের এক নেতা জানান, গত পরশু পর্যন্ত ঠিক ছিল অন্তত পঁচিশ হাজার সমর্থক এনে দিল্লির রাস্তায় লন্ডভন্ড করা হবে। কিন্তু রাতারাতি সেই পরিকল্পনা বদলে ফেলেন কংগ্রেস সভানেত্রী। দলীয় সূত্রে বলা হয়, তার কারণ মূলত দু’টি। l আদালতের বাইরে হট্টগোল করে বিচার ব্যবস্থাকে রুষ্ট করতে চাননি সনিয়া। l দলের নেতারা মনে করেন, রাস্তায় নেমে লন্ডভন্ড করলে নেতিবাচক বার্তা যাবে। মনে হতে পারে, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় কংগ্রেসের যুক্তি নড়বড়ে বলেই বেশি লম্ফঝম্ফ করছে।

তাই নাটক হল ঠিকই। কিন্তু পরিমিত সেই নাটককে বড় করে দেখাতে দিনভর ব্যস্ত রাখা হল সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাকে। কংগ্রেস নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সকাল থেকে পিল পিল করে যখন আজ চব্বিশ আকবর রোডের সামনে আসতে শুরু করেন, তখনই এক বার নিজে গাড়ি চালিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন রাহুল। পরনে তখন ধূসর রঙের সোয়েট শার্ট ও জিন্‌স। সেই সময় তাঁকে নিয়ে এক প্রস্ত স্লোগান চিৎকার চলে। সদর দফতরের এক-একটি ঘর দখল করে ততক্ষণে টিভিতে লাইভ বিতর্কে দলের মত জানাতে শুরু করে দিয়েছেন অন্তত দু’ডজন মুখপাত্র। এর পর দুপুর ১টা নাগাদ চব্বিশ আকবর রোডে উপস্থিত হন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্য ও সাংসদরা।

কংগ্রেস দফতরে যখন এই নাটক চলে তখন আদালতের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল অন্য রসদ। সনিয়া-রাহুল আদালতে পৌঁছনোর আগেই সেখানে পৌঁছে যান মেয়ে প্রিয়ঙ্কা বঢড়া। সেই সঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল, অম্বিকা সোনি, মহসিনা কিদওয়াই, এ কে অ্যান্টনি, পি চিদম্বরম, শীলা দীক্ষিত, রাজীব শুক্লর মতো নেতারাও আদালতে পৌঁছে যান। আদালত চত্বরে এঁদের সবারই গাড়ি নিয়ে ঢোকার অনুমতি ছিল। কিন্তু এঁরা তো বটেই, সনিয়া-রাহুলও গাড়ি থেকে নেমে পড়েন গেটের পঞ্চাশ মিটার আগে। তার পর সমর্থক ও টিভি ক্যামেরার উদ্দেশে হাত নাড়াতে নাড়াতে হেঁটে আদালত চত্বরে প্রবেশ করেন মা-ছেলে!

শুনানি চলে মেরেকেটে সাত মিনিট। তার মধ্যেই পূর্বসিদ্ধান্ত মতো, সনিয়ার হয়ে বন্ডে সই করেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি। দাদার জন্য বন্ডে সই করেন বোন প্রিয়ঙ্কা। আহমেদ পটেল, বি কে হরিপ্রসাদরাও একে একে বাকি অভিযুক্তদের জন্য বন্ডে সই করেন। ভেবেচিন্তেই রবার্ট বঢড়াকে আজ আদালত চত্বরে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। কারণ রবার্ট এলে তাতে দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে আনার সুযোগ পেত বিরোধীরা, কিংবা সংবাদমাধ্যম। যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় শাশুড়ি ও শ্যালকের প্রতি সমর্থন জানাতে ভোলেননি রবার্ট।

সনিয়া-রাহুলের হাজিরাকে ঘিরে আজ ধুন্ধমার কোনও হাঙ্গামা যে হবে না, গত কালই তার আঁচ মিলেছিল নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে। সনিয়ারা জামিন নিতে না চাইলে কী হবে, কী ভাবে তাঁদের তিহাড় জেলে নিয়ে যাওয়া হবে— এমন সব প্রসঙ্গ উঠতেই, কংগ্রেসের প্রতিনিধি আশ্বস্ত করেছিলেন, এ সব নিয়ে ভাবার প্রয়োজন হবে না। তবে মোদী সরকার ও বিজেপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আঁচ বাড়ানোর কাজে এই হাজিরাকে পুরো দস্তুর কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও করে রেখেছিল সনিয়ার দল।

সেই অনুযায়ীই ত্রিপুরা, অসম-সহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রদেশ কংগ্রেস কর্মীরা এ দিন বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এই অভিযোগে সরব হয়েছেন যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই বিজেপি ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলায় সনিয়া-রাহুলকে জড়িয়েছে। আর দিল্লিতে? ঠিক করাই ছিল, আদালতের পর্ব মিটতেই দলের সদর দফতরে যাবেন সনিয়া-রাহুল, বাকি সব অভিযুক্ত ও দলের নেতারা। সেটাই হল। সনিয়ারা এসে পৌঁছনোর আগেই সেখানে কান পাতা দায় হচ্ছিল। দলনেত্রীকে দেখে যেন বাঁধ ভাঙল চিৎকার ও ক্ষোভের।

সংযমের বেড়াটা কার্যত ভেঙে দিলেন সনিয়াই। এবং রাহুলও। পর পর দু’জনেই যে ভাবে মোদী সরকারের মুণ্ডপাত করলেন তাতে স্পষ্ট, এ বার এই রণং দেহি মেজাজটারই সংক্রমণ চাইছেন তাঁরা। আদালতকে অবমাননা করা যাবে না। কোর্টের বাইরে হট্টগোল করাও চলবে না। কিন্তু বিজেপি তথা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে হেস্তনেস্ত করার জন্য দলে এই মেজাজটাই ধরে রাখতে, এবং পারলে আরও ছড়িয়ে দিতে চাইছেন মা-ছেলে

Subramanian Swamy BJP congress sonia gandhi rahul gandhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy