শৌচালয়ের তদারকিতে হাজির মন্দ্রিতা। পার্থ চক্রবর্তীর তোলা ছবি।
এত এত স্বপ্ন ভরা ছিল এগারো বছরের দু’টো হাতের মুঠোয়! ছিল ‘বড়দের মতো’ এত গভীর ভাবনা! ক্লাস সিক্সের মেয়ের গল্প শুনছে আর ভাবছে অবাক জামশেদপুর।
জল চিকচিক মেয়ের বাবা-মায়ের চোখের কোণেও। এক বছর ধরে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি ‘লক্ষ্মী’ মেয়ে। শুধু এক দিন হঠাৎ করেই উপুড় করে দিয়েছে নিজের ঝাঁপি। কোথাকার কোন অচেনা কয়েকটা মেয়ে, কেউ কেউ বয়সে ওরই মতো হবে হয়তো— তাদের ভালর জন্য দিয়েছে ২৪ হাজার টাকা!
দিয়েছে নিজের লক্ষ্মীর ভাঁড়় ভেঙে। জামশেদপুরের টেলকো হিলটপ স্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্রী মন্দ্রিতা চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া সেই টাকাতেই তৈরি হচ্ছে দু’টি শৌচাগার— টেলকো কলোনি লাগোয়া আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম কেন্দ্রাডিহতে।
লক্ষ্মীর ভাঁড়ে জমানো টাকায় কেউ জামা কেনে। কেউ রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। কেউ অন্য কোনও শখ মেটায়। আর এই কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলে মন্দ্রিতা বলছে, ‘‘স্কুলের সঙ্গে সচেতনতার প্রচারে গিয়ে দেখেছি, গ্রামে শৌচালয় না থাকায় আমার বয়সি মেয়েদের কত অসুবিধে হচ্ছে। ওদের অসুখ হচ্ছে। ভাবলাম আমার জমানো টাকাটা তাই শৌচালয় নির্মাণের জন্য দিয়ে দিই।’’
এক বছর আগে বেশ বড় একটা ভাঁড়ে টাকা জমানো শুরু করেছিল মন্দ্রিতা। ওর বাবা অমিত চট্টোপাধ্যায় জানালেন, আগেও ভাঁড়ে টাকা জমিয়ে তা দিয়ে গল্পের বই কিনেছে মেয়ে। এ বার যখন জমাতে শুরু করে তখন বলেছিল, ‘‘বাবা, আর খুচরো পাঁচ-দশ টাকা নয়। এ বার একটু বেশি টাকা দাও। একটা কাজ আছে।’’ পেশায় বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তা অমিতবাবু বলেই ফেললেন, মেয়ের আবদারে প্রথমে একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। ‘‘তবে জানতাম, ওইটুকু মেয়ের ভাঁড়ে টাকা জমানো মানে তো আমাদেরই সঞ্চয়। তাই একশো বা পাঁচশো টাকা ওর হাতে দিতে দ্বিধা করিনি। যখন যেমন হাতের কাছে থাকত, দিতাম,’’ বলছিলেন তিনি।
দেখতে দেখতে ভরে উঠল ভাঁড়। মন্দ্রিতার মা স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ভাঁড় ভেঙে দেখা গেল, তাতে ২৪ হাজার টাকা হয়েছে। এর পরেই মন্দ্রিতা আমাদের জানায়, এই টাকা সে গ্রামে শৌচাগার তৈরির জন্য দিতে চায়। আমরা ওর কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম।’’ চমকেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঘোর কাটতে মেয়েকে জড়িয়েও ধরেছিলেন।
বাধা ছিল একটাই। পুরনো নোট বাতিল হওয়া। ভাঁড়ের পাঁচশো টাকার নোটগুলো তাই প্রথমে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করতে হয়েছিল অমিতবাবুকে। তার পর ২৪ হাজার একটা চেক নিয়ে পূর্ব সিংভূমের জেলাশাসক অমিত কুমারের দফতরে যান তিনি। খুলে বলেন মেয়ের ইচ্ছের কথা। পরে জেলাশাসক বলছিলেন, ‘‘এইটুকু মেয়ের সচেতনতা দেখে আমরা সকলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি।’’
অবাক মন্দ্রিতার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পুনীতা বি চৌহানও। বললেন, ‘‘স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নানা অনুষ্ঠানে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা সামিল হয়। পাড়ায় জঞ্জাল পরিষ্কার থেকে শুরু করে গ্রামে গিয়ে শৌচাগার নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীদের সচেতন করে ওরা।’’
এমন অভিযানে যেতে যেতেই তো নিজের স্বপ্ন বোনা শুরু করেছিল মন্দ্রিতা। যেমন এখন বুনছে তার সহপাঠীদের অনেকে। হিলটপ স্কুলের কেউ কেউ একই উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই টাকা জমাতে শুরু করে দিয়েছে। খুব খুশি মন্দ্রিতা।
লক্ষ্মীর ঝাঁপি কি আর শূন্য থাকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy