মা-বাবা খুশি। কারণ ছেলে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। সব ক’টি বিষয়ে লেটার। এতটা আশা করেননি তাঁরা। কারণ ছ’বছর ধরে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী চন্দ্রপুরের পীযূষকান্তি দাস। স্ত্রী টিউশনি
করে যা উপার্জন করেন তা দিয়েই সংসার চলে। মা ঊষা দাসের কথায়, ‘‘ছেলের পড়াশোনা দেখভালের সামর্থ কোথায় আমাদের।’’
আর বিশালের আক্ষেপ, চারটে নম্বরের জন্য মেধা তালিকায় নাম তোলা গেল না। আরেকটু ভাল করা উচিত ছিল। উচিত-অনুচিতের কথা বলতে চান না অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রশান্তকুমার নাথ। তিনি বলেন, ‘‘যে ভাবে ছেলেটি পড়াশোনা করেছে, তাতে ৫৬২ নম্বর তোলা বড় কঠিন। সে করে দেখিয়েছে। আমরা খুশি।’’
খুশি চন্দ্রপুরের মানুষও। শিলচর শহর থেকে কাঁঠাল রোড পেরিয়ে অনেকটা গেলে চন্দ্রপুর গ্রাম। বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি। চারের জন্য মাধ্যমিকে স্থান অধিকার করতে পারেনি, এই পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল আজ। লোকসঙ্গীত শিল্পী বিধান লস্কর বললেন, ‘‘দীপুদার (পীযূষ দাসের ডাক নাম) মতো ভাল লোক এই এলাকায় নেই। একই রকম তাঁর দুই ছেলে। পড়াশোনার বাইরে কিছুই বোঝে না। এর পুরো কৃতিত্ব ঊষাদেবীর।’’
ঊষাদেবী অবশ্য কৃতিত্ব ভাগ করে নিতে চান স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কুলে যেমন বিশালের প্রতি সবার বাড়তি নজর ছিল, তেমনই কেউ কেউ বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওকে পড়িয়েছেনও। উল্লেখ করেন অঙ্ক-বিজ্ঞানের শিক্ষক সজলকান্তি দাস এবং সমাজবিদ্যা-বাংলা-ইংরেজির শিক্ষিকা শ্রাবণী দাসের কথা।
কিন্তু এখন কী হবে, এ নিয়েই দুশ্চিন্তা ঊষাদেবীর। ছেলের ইচ্ছে, বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবে। পরেআইএএস হবে। সমাজের গরিব মানুষের দুঃখ দূর করবে। মা এখনই এত দূর ভাবতে পারেন না। তাঁর সামনে এ বড় সমস্যার সময়। একাদশে ছেলেকে ভর্তি করানোই এখন চিন্তা। ঊষাদেবী বলেন, ‘‘স্বামীর জন্য নিয়মিত ওষুধ কেনাই সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতি মাসে অন্তত ৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। ভাগ্যিস ইন্দিরা আবাস মিলেছিল। তাই মাথায় ছাদটুকু আছে।’’ ছেলে মাকে অভয় দেয়। শিক্ষকদের কথা বলে। ফলপ্রকাশের আগেই সে যোগাযোগ করেছে বিশ্বজিৎ ঘোষ ও কৃষ্ণজ্যোতি দেবের সঙ্গে। একজন বিনা ফি-তে তাকে অঙ্ক দেখাবেন। অন্যজন রসায়ন।
পীযূষবাবু শহরের বিভিন্ন দোকানে কর্মচারীর কাজ করেছেন। পরিশ্রম ও সততার জন্য সকলের ভালবাসা পেয়েছেন। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার ভালই চলছিল। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু ২০১০ সালে কী করে যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে গেল! সে থেকে পক্ষাঘাত। কোমরের নীচের অংশ পুরো অসার। বিছানাতেই কাটে দিনরাত।’’ পরে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন গত বছরের মার্চে। গলার স্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাসতিনেক ধরে সামান্য কথা
বলতে পারছেন।
পীযূষবাবু বলেন, ‘‘সংসারের চিন্তাতেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হই। সব বুঝেও রোগের জন্য আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। এ যে কী জ্বালাতন!’’ পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেয় বিশাল, ‘‘এত ভেবো না। সমাজ তো রয়েছে। তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। পরে আইএএস হয়ে আমি তাঁদের ঋণশোধের চেষ্টা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy