Advertisement
০৬ মে ২০২৪
মাথা তুলছে বিরোধী সুর

মোদীর কর্তৃত্ব কমছে কি, প্রশ্ন দলেই

ললিত মোদী বিতর্কে নরেন্দ্র মোদী সরকারের অস্তিত্বের সঙ্কট নেই ঠিকই, কিন্তু ভাবমূর্তির সঙ্কট যে তৈরি হয়ে গেল, তা কবুল করছেন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা। আর সেই সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

‘আমার ছোট্ট বন্ধু, ইসকন আয়োজিত ভগবদ্গীতা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বিজয়ী মরিয়ম আসিফ সিদ্দিকির সঙ্গে।’— ছবি দিয়ে টুইট করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুম্বইবাসী ১২ বছরের মরিয়ম পুরস্কারের ১১ হাজার টাকা দান করেছে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল-সহ নানা প্রকল্পে। ছবি: পিটিআই।

‘আমার ছোট্ট বন্ধু, ইসকন আয়োজিত ভগবদ্গীতা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বিজয়ী মরিয়ম আসিফ সিদ্দিকির সঙ্গে।’— ছবি দিয়ে টুইট করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুম্বইবাসী ১২ বছরের মরিয়ম পুরস্কারের ১১ হাজার টাকা দান করেছে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল-সহ নানা প্রকল্পে। ছবি: পিটিআই।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

ললিত মোদী বিতর্কে নরেন্দ্র মোদী সরকারের অস্তিত্বের সঙ্কট নেই ঠিকই, কিন্তু ভাবমূর্তির সঙ্কট যে তৈরি হয়ে গেল, তা কবুল করছেন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা। আর সেই সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

এক শীর্ষ আরএসএস নেতার কথায়, ‘‘জল যখন পাথরের উপরে পড়ে, তখন প্রথম প্রথম মনে হয় পাথরের আর কী ক্ষতি হবে! কিন্তু লাগাতার জল পড়তে থাকলে অজান্তেই ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। আর এক দিন দেখা যায়, পাথর ফুটো হয়ে গিয়েছে।’’ ফলে মোদীর সরকার মানবিকতার যুক্তি দিয়ে সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়ালেও ললিত মোদীকে ব্রিটেনের ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পেতে সাহায্য করার ঘটনা যে তার গলার কাঁটা হয়ে গেল, সেটা মানছেন দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই। কারণ, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এটাই দুর্নীতির প্রথম অভিযোগ। এবং সেটা এমন একটা সময় এল, যখন ‘অচ্ছে দিন’-এর স্লোগান তুলে সরকার বর্ষপূর্তি পালন করছে। আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে গোটা দেশে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ উস্কে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই সব উদ্যোগে খানিকটা হলেও জল ঢেলে দিলেন ললিত মোদী।

রবিশঙ্কর প্রসাদ, অরুণ জেটলির পরে সরকারের হয়ে আসরে নেমে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া আজ কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ইউপিএ সরকারই ললিত মোদীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেস কেন ললিতকে দেশে ফেরায়নি? কে ওদের বারণ করেছিল!’’ সুষমা কোনও অন্যায় করেননি বলে দাবি করে গৌড়ার মন্তব্য, ‘‘সুষমার ভূমিকায় দল মোটেই বিব্রত নয়। ক্যানসার আক্রান্ত এক জন ব্যক্তিকে সাহায্য করা নিয়ে কোনও আলোচনাই চলতে পারে না।’’ আর বসুন্ধরা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, দল গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। সব তথ্য হাতে আসার পরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমন সাহসী মুখ দেখানোর পরেও বিজেপি এবং সঙ্ঘ নেতাদের উদ্বেগ দু’টি কারণে। প্রথমত, এই ঘটনায় বিরোধীরা রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। একেবারে প্রথম দিন থেকেই আসরে নেমেছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন তিনি। তার পর গত দু’দিনে আনন্দ শর্মা এবং পি চিদম্বরমকে দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করিয়েছে কংগ্রেস। তাঁরা রবিশঙ্কর প্রসাদ ও অরুণ জেটলির দেওয়া যুক্তি খণ্ডনের পাশাপাশি সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজের ইস্তফা দাবি করেছেন। কংগ্রেস তথা বিরোধীরা তাদের আক্রমণকে কত দূর নিয়ে যেতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন বিজেপি এবং সঙ্ঘ নেতারা। কেউ কেউ মনে করছেন মোদী যদি গোড়াতেই সুষমাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিতেন, তা হলে বিরোধীদের আক্রমণ অনেকটাই ভোঁতা করে দেওয়া যেত। ঠিক যেমন ভাবে রাজীব গাঁধী আচমকা সংসদে এসে প্রেস বিল প্রত্যাহার করে প্রবল বিক্ষোভে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই মতের বিরোধীদের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে আবার এটা মনে হতো যে, প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন। প্রশ্ন উঠে যেত তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে।

বস্তুত, ললিত মোদীর ঘটনা ঘিরে দলের বিভিন্ন নেতার মধ্যে টানাপড়েন এবং তার জেরে মোদীর কর্তৃত্বে ভাটা পড়ার সম্ভাবনাই এখন সঙ্ঘ এবং বিজেপির নেতাদের দ্বিতীয় মাথাব্যথা। এই খবর ফাঁস হওয়ার পিছনে দলের অনেকেই অরুণ জেটলি শিবিরের হাত দেখছেন। কারণ, দলীয় রাজনীতিতে সুষমা এবং বসুন্ধরা দু’জনেই জেটলির বিরোধী বলে পরিচিত। ওই বিজেপি নেতারা বলছেন, লন্ডনের একটি সংবাদপত্রে যখন ললিত মোদীর খবরটি প্রকাশিত হয়, তখন তাতে সুষমা স্বরাজের নাম ছিল না। বিদেশমন্ত্রীর নাম প্রকাশ্যে আসে পরে। অনেকের ধারণা, জেটলি শিবিরই সুষমার নাম ফাঁস করেছে। জেটলির ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য ললিত-বিরোধী ক্রিকেট লবিকেই দায়ী করছে। এন শ্রীনিবাসনের হাত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা।

কিন্তু সরকারের মুখরক্ষার সাংবাদিক বৈঠকে অরুণ জেটলি যে ভাবে কৌশলে ললিত সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায় একা সুষমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন, তাতে জল্পনা বেড়েছে বই কমেনি। বিজেপির বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়েছেন দলের ক্রিকেটার-সাংসদ কীর্তি আজাদ। তিনি সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন ‘আস্তিনের সাপটি কে?’ যে মন্তব্যের লক্ষ্য জেটলি বলেই মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিজেপি নেতা শত্রুঘ্ন সিন্হা আবার বলেছেন, ‘কীর্তি আজাদ ভুল বলেন না।’ এই সব মন্তব্যকে বিক্ষুব্ধ স্বর মাথা চাড়া দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন সঙ্ঘ এবং বিজেপির নেতারা।

সরকারের ভাবমূর্তিতে আঁচ পড়ার পরে দলে বিক্ষুব্ধরা যে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবেন, সেটা বুঝছেন মোদী। এটা ঠিক যে, তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলতে পারেন, এমন কোনও নেতা এই মুহূর্তে বিজেপিতে নেই। কিন্তু এর মধ্যেই জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে পরোক্ষে মোদীর সরকারকে কটাক্ষ করেছেন কোণঠাসা নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। এ বার মোদীর কর্তৃত্বে ফাটল ধরলে মেনকা গাঁধী, তাঁর ছেলে বরুণ, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান বা ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহেরা গলা তোলা শুরু করতে পারেন।

দলে বিরোধী সুর যে তৈরি হচ্ছে, তার প্রমাণ অতি সম্প্রতিই পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। গত এক বছর বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে মোদী একাই বক্তৃতা দিতেন। বেঙ্কাইয়া নায়ডু, প্রকাশ জাভড়েকরেরা তাঁকে পরামর্শ দেন, সাংসদদেরও বলতে দেওয়া হোক। অমিত শাহ এ প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মোদী রাজি হয়ে যান। আর বলার সুযোগ পেয়েই বালিয়ার সাংসদ দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, আচ্ছে দিন এসে গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এর পর সংসদীয় দলের বৈঠকে সাংসদদের আর মুখ খোলার সুযোগ দেওয়া হয়নি বটে, কিন্তু ক’মাস আগেও এমন ঘটনা যে অভাবনীয় ছিল, তা মানছেন বিজেপি নেতারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে মেনকার সঙ্গে জেটলি, স্মৃতি ইরানির মতো নেতাদের বিবাদও শুরু হয়েছে।

বিজেপির এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, ‘‘ভোটের আগে আডবাণী-রাজনাথ-সুষমা, কেউই মোদীকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করতে চাননি। কিন্তু দলের নিচুতলার কর্মীদের বিপুল সমর্থনের জেরে সেই বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আজ ললিত মোদী কাণ্ডে যদি জনমানসে সরকার সম্পর্কে ধারণা বিরূপ হয়, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বও দুর্বল হয়ে পড়বে। যে বিক্ষুব্ধ নেতারা এত দিন টুঁ শব্দটি করেননি, তাঁরাও ছোবল মারতে উদ্যত হবেন।’’

মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য কোনও সিঁদুরে মেঘ দেখার কথা স্বীকার করছে না। তাদের দাবি, এটা কোনও সঙ্কটই নয়। কিন্তু বিজেপির অন্য অংশের বক্তব্য, সরকারের অস্তিত্বের সঙ্কট না-থাকলে ক্ষমতাসীনরা কোনও বিপদকেই বিপদ বলে মনে করেন না। ঘটনা হল, আগের এনডিএ জমানায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধে যখন তহলকা ও কফিন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল, তখন তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘ও আমরা সামলে নেব।’ টু জি কেলেঙ্কারির সময়ও একই সুরে চিদম্বরম বলেছিলেন ‘ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।’ নরেন্দ্র মোদীর সামনে লোকসভা ভোট নেই ঠিকই, কিন্তু বছর শেষে বিহারে নির্বাচন। দিল্লির ভোটে গোহারান হার তাঁর কর্তৃত্বে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিহারে কাঙ্ক্ষিত ফল না হলে তা আরও ধাক্কা খাবে বলেই দলের বড় অংশের মত।

কোনও কোনও বিজেপি নেতা বলছেন, বিহারের ভোট আসতে আসতে ললিত মোদী বিতর্ক দম হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু সঙ্ঘ নেতাদের অনেকের প্রশ্ন, এই কেলেঙ্কারি ঘিরে যে নতুন তথ্য ফাঁস হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিজেপি সূত্রের খবর, রাজস্ব গোয়েন্দা দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন গোয়েন্দাদের গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মোদী। ওই সূত্রের বক্তব্য, প্রকাশ্যে স্বীকার না-করলেও মোদী-জেটলি যে ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন, এই সতর্কতাই তার প্রমাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE