ট্রেন বেলাইন হোক বা এক লাইনে একই সময়ে ঢুকে পড়ুক একাধিক ট্রেন, যাবতীয় বিপত্তিতে প্রথমেই কোপ পড়ে রেলের নিচু তলার কর্মীদের ঘাড়ে। অধস্তনদের বলির পাঁঠা করে কর্তারা আড়াল খোঁজেন বলেই রেলের অন্দরের অভিযোগ। পরপর দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এ বার হুঁশিয়ারি দিলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে না-পারলে তার ফল ভুগতে হবে রেলকর্তাদেরই। গুরুতর গাফিলতি ধরা পড়লে পদ থেকে সরেও যেতে হতে পারে।
যাত্রী-সুরক্ষা নিয়ে বৃহস্পতিবার সব জোনের জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে ভিডিও-সম্মেলন করেন প্রভু। লাগাতার ট্রেন-দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ ওঠে সেখানে। চরমপত্র দিয়ে রেলমন্ত্রী জানিয়ে দেন, দুর্ঘটনা রোধে দশ দিনের মধ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পরে দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেনারেল ম্যানেজার, ডিভিশনাল ম্যানেজার থেকে ট্রেন চলাচলের সঙ্গে যুক্ত সব অফিসারকে। ওই দিনই পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলে যাত্রী-সুরক্ষা নিয়ে আলোচনায় মন্ত্রকের কড়া মনোভাবের কথা জানান রেল প্রতিমন্ত্রী রাজেন গোহাঁই।
২২ নভেম্বর কানপুরের কাছে রাজেন্দ্র এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১৫০ জন যাত্রীর। তদন্তে জানা যায়, রেললাইনে সমস্যা ছিল। তার পরেই দুর্ঘটনাপ্রবণ সব অ়ঞ্চল চিহ্নিত করার জন্য প্রতিটি জোনকে নির্দেশ দেয় রেল মন্ত্রক। দুর্ঘটনা এড়াতে সেই সব জায়গায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তার পরেও ২৮ ডিসেম্বর কানপুরের কাছে রুরিতে বেলাইন হয় শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস। লাইনের ত্রুটিতেই এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হচ্ছে।
পরপর দুর্ঘটনায় বিড়ম্বনায় পড়েছে রেল মন্ত্রক। ভিডিও-সম্মেলনে মন্ত্রীর কড়া বার্তায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেক রেলকর্তা। মন্ত্রীর চরমপত্রের লক্ষ্য যাঁরা, সেই রেলকর্তাদের অনেকের আক্ষেপ, উপর্যুপরি দুর্ঘটনার জেরে মন্ত্রক এখন তাঁদের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে রেলকর্তাদের একটা বড় অংশকে টুইটার ও ফেসবুকে যাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং তাঁদের তাৎক্ষণিক সহায়তার কাজেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। রেল বোর্ডের নির্দেশেই ওই কাজকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ফলে যাত্রী-সুরক্ষায় নজর দেওয়াটা গৌণ হয়ে পড়েছে। অথচ এখন চরমপত্র দিয়ে পদচ্যুতির হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন মন্ত্রী।
পরিকাঠামো উন্নত না-করে এই ধরনের চরমপত্রে কাজ কতটা হবে, প্রাক্তন রেলকর্তাদের অনেকে সেই বিষয়ে সন্দিহান। তাঁদের বক্তব্য, রেলে দু’টি কাজেরই অগ্রাধিকার। সুষ্ঠু পরিষেবা আর নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা। এই দু’টি বিষয়কে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়ার বদলে বুলেট ট্রেনের মতো উচ্চাশী প্রকল্প বা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত থাকা কোনও কাজের কথা নয়। ওই প্রাক্তন কর্তাদের মতে, রেলের উচিত পরিকাঠামোর ত্রুটি সংশোধনে নজর দেওয়া। কারণ, দু’তিন বছরে যত ট্রেন-দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সব ক’টিরই মূলে ছিল পরিকাঠামোর ত্রুটি। সেই ত্রুটি দূর করাই রেলের মূল কাজ হওয়া উচিত।
রেলকর্তাদের কড়া বার্তা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেল মন্ত্রক অবশ্য যাত্রী-সুরক্ষায় পাঁচ দফা দাওয়াইও বাতলেছে। সেগুলো হল: l রেলের হাতে ইন্টিগ্র্যাল কোচ কারখানার তৈরি ৪৫ হাজার কামরা রয়েছে। সেগুলিকে এলএইচবি (লিঙ্ক হফম্যান বুশ) কামরায় রূপান্তরিত করা হবে। দুর্ঘটনাতেও যা দুমড়ে যাবে না বা একটি অন্যটির উপরে উঠে যাবে না। l কানপুরে দুর্ঘটনার পরে গড়া টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ তিন ধাপে রূপায়ণ করা হবে। l রুটিন পর্যবেক্ষণ ছাড়াও প্রতিটি মেল, এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে এক জন উচ্চপদস্থ অফিসার এবং ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার এক জন কর্মী থাকবেন। l যাত্রী-সুরক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার কী ভাবে বাড়ানো যায়, তার পরামর্শ দিতে জাপান ও কোরিয়ার রেল সংস্থাকে অনুরোধ করা হয়েছে। l কর্মীদেরও বিশেষ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy