Advertisement
০৮ মে ২০২৪
National News

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠকে উঠল তিস্তা জলবণ্টন ও গো-রক্ষা প্রসঙ্গ

তিস্তা জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলেছিলেন। সে প্রসঙ্গে ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, ‘‘আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নদী আইনও জানি। নিয়মমতে নদীর ধারার নিম্নদিকে থাকা দেশকে জলের ভাগ দেওয়া বাধ্যতামূলক।

গুয়াহাটিতে অষ্টম ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠক। —নিজস্ব চিত্র।

গুয়াহাটিতে অষ্টম ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠক। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৭ ১৭:৫৭
Share: Save:

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠকের মঞ্চেই উঠে এল গো-রক্ষকদের তাণ্ডবের কথা। এল জলবণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, জঙ্গি আশ্রয় ও অনুপ্রবেশের অপ্রীতিকর প্রসঙ্গও। অষ্টম ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠকের পরে দু'দেশের মন্ত্রী-আমলা-নেতারাই শপথ নিলেন যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাগুলি মিটিয়ে দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ়তর করা হবে। গুয়াহাটিতে হওয়া তিন দিনের বৈঠকে অসমের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, ত্রিপুরার রাজ্যপাল, বাংলাদেশ ও ভারতের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দুই দেশের আরও অনেক নেতা, আমলা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অংশ নেন।

তিস্তা জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলেছিলেন। সে প্রসঙ্গে ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, ‘‘আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নদী আইনও জানি। নিয়মমতে নদীর ধারার নিম্নদিকে থাকা দেশকে জলের ভাগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তিস্তা নয়, আমার মধ্যে জলঢাকা, তোর্ষা, মহানন্দা-সহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলির জলের ভাগ বাংলাদেশকেও দেওয়া উচিত। আমাদের দিকে জলের সমস্যা বলা হচ্ছে। আমার মতে, সমস্যা হলে সেটাও ভাগ করতে হবে। কিন্তু জল দেওয়া বন্ধ করা ঠিক নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশেরও টিপাইমুখ বাঁধে আপত্তি করা অনুচিত। বরাক নদীর জলপ্রবাহ বন্ধ করবে না ওই বাঁধ। তেমনটা হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, অসমের বরাক উপত্যকাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেমনই চিন যদি সিয়াং নদীর উপরের অংশে বাঁধ দেয়, তবে শুধু অসমে ব্রহ্মপুত্র নয়, বাংলাদেশের যমুনাও প্রভাবিত হবে।’’ রাম মাধব বলেন, ভারত সরকার যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সব মানা হবে। তিস্তা নিয়েও কথা রাখবে কেন্দ্র। এ কথা বলতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা হাততালি দেন।

আরও পড়ুন

যুক্তিগ্রাহ্য কারণে বাতিল নোট নেওয়া যাবে না কেন, জানতে চায় সুপ্রিম কোর্ট

বিজেপি-র জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বলেন, ‘‘ভারত বাংলাদেশ পৃথক দেশ হলেও সভ্যতা-সংস্কৃতি-সমাজের ধারাবাহিকতা বহন করে। কিন্তু তার মধ্যে কাঁটার খোঁচার মতো বিঁধছে ধর্মান্ধতা।’’ ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘গো-রক্ষা অবশ্যই পবিত্র কাজ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানবরক্ষা। গো-রক্ষার নামে মানুষরে মারধর করা, হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের স্বপ্নে কালি ছেটাচ্ছে ধর্মান্ধ, উগ্র জাতীয়তাবাদীর দল। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করা উচিত নয়।’’

রাজ্যপাল তথাগত রায়ও বাংলাদেশের উগ্র ধর্মান্ধতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ধামরাই রথযাত্রায় বাধা, তাহেরপুরে মন্দিরে আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর কন্যার হাতে এখন দেশের দায়িত্ব। আশা করি তিনি সুযোগ্য হাতে সমস্যার মোকাবিলা করবেন।’’

অসমে অনুপ্রবেশের সমস্যা বাংলাদেশ সরকার মানে না। শণাক্ত হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরত নিতেও চায় না পড়শি দেশ। তাই অসমের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ঘুরিয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ চলছে বলে অনেকের বিশ্বাস। এ বছরের শেষে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রকাশ হলেই বোঝা যাবে রাজ্যে বহিরাগতের সংখ্যা কত। সেই তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দ্বারস্থ হব আমরা। তখন কিন্তু সেখানকার সরকারের সাহায্য চাই। রাম মাধবও বলেন, ‘‘সীমান্তে গরু পাচার ও অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।’’

হিমন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বিশেষ জোর দেন। বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতে মাল আনা-নেওয়া করলে পরিবহণের সময় ও খরচ বাঁচবে। বাংলাদেশও ‘ট্রানজিট-ফি’ বাবদ বছরে অনেক টাকা পেতে পারে।’’ তাঁর আরও প্রস্তাব, ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত চলা অবৈধ বাণিজ্যে দু’দেশেরই রাজস্ব নষ্ট হচ্ছে। তার চেয়ে সীমান্তে বৈধ বাণিজ্য শুরু করলে লাভ। তাই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিশেষ ‘সীমান্ত ইকনমিক জোন’ তৈরি করা হোক।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করায় এই অঞ্চলে জঙ্গি সমস্যা অনেক কমেছে। অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দেন হিমন্ত ও তথাগত রায়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ টেনে তথাগতবাবু বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকার ভারতের জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করায় উত্তর-পূর্বে জঙ্গি সমস্যা কমেছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ দেখিয়েছে বাংলাদেশের জঙ্গিরা কী ভাবে ভারতের মাটিতে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিচ্ছে।

বাংলাদেশের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাঙ্কের মতে ভারতের উত্তর-পূর্ব, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান মিলিয়ে এই এলাকাই বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। আমাদের প্রধান শত্রু হল দারিদ্র্য। সামনে আরও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক টানাপড়েন আসতে পারে। তাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ মিটিয়ে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’’

বৈঠকের শেষে ‘গুয়াহাটি ডিক্লারেশন’ সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। সীমান্তকে ‘বিতর্কিত ক্ষেত্র’ নয়, ‘সমৃদ্ধি ক্ষেত্র’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যের পরিবেশ বজায় রাখবে দুই পক্ষ। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নিবিড়তর করা হবে। বিশেষ জোর দেওয়া হবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পর্যটন, প্রযুক্তি, কৃষিক্ষেত্র, শিল্প ও জলপথ পরিবহণে। যে হেতু দুদেশের বাণিজ্যবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম, তাই আগামী বছরের শুরুতে কক্সবাজারে নবম ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বৈঠক বসবে। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সমাবেশও হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE