Advertisement
E-Paper

মহাপ্রস্থানের পথে হাজারো গরু, সঙ্গে অস্ত্র-মাদকও

গোয়েন্দারা বলছেন রাজশাহি আর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েই খাগড়াগড়ে তৈরি বোমা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে জঙ্গিরা। তত্ত্ব-তালাশে সেখানে যাচ্ছে এনআইএ-র দল। তার আগে পড়শি দেশের ওই দু’জায়গা ঘুরে সীমান্ত পারের পাচার-চিত্র দেখে এল আনন্দবাজার। জঙ্গিদের পায়ে পায়ে। চতুর্থ কিস্তি।গোয়েন্দারা বলছেন রাজশাহি আর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েই খাগড়াগড়ে তৈরি বোমা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে জঙ্গিরা। তত্ত্ব-তালাশে সেখানে যাচ্ছে এনআইএ-র দল। তার আগে পড়শি দেশের ওই দু’জায়গা ঘুরে সীমান্ত পারের পাচার-চিত্র দেখে এল আনন্দবাজার। জঙ্গিদের পায়ে পায়ে। চতুর্থ কিস্তি।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৯

বেনাপোলে সীমান্ত পেরিয়ে রাস্তা ছুটেছে যশোর শহরের দিকে। মাঝে নাভারনের মোড় থেকে ডান দিকের রাস্তা তুলনায় সরু, দেখভালের অভাবে অনেকটাই রুখুশুখু। সাতক্ষীরা অভিমুখী এই রাস্তা ধরে এগোতেই উল্টো দিক থেকে ছুটে আসতে লাগল একের পর এক ট্রাক। কিছু তিন চাকার টেম্পোও। সবই বেশ লজ্ঝড়ে, কিন্তু গতিতে দুর্বার। ভাঙা রাস্তায় বিকট শব্দ তুলে দৌড়চ্ছে একটার পর একটা গাড়ি।

সব গাড়িই গরুতে বোঝাই। লাল, ধলা, পাঁশুটে, কালো। ধাড়ি গরুর পাশে ছোট বাছুর, বুড়ো বলদের পাশে এক-শিং ভাঙা ষাঁড়। ভাঙাচোরা সড়কে গাড়ি ছুটছে, তারাও নাচছে। কেউ কেউ গাড়ির পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যেন দেখতে চাইছে আর কদ্দুর!

কিন্তু গরুবোঝাই সব গাড়ি এত ভয়ানক জোরে দৌড়চ্ছে কেন?

নাতির হাত ধরে রাস্তার পাশে সিঁটিয়ে দাাঁড়ানো স্থানীয় এক প্রৌঢ়ের জবাব, “চাঁদাবাজির হাত থেকে বাঁচতে হবে তো! তাই দৌড়। ধাক্কা মেরে দেবে বলে কেউ দাঁড় করায় না। পুলিশকেও ডরায় না এরা!”

কয়েক কিলোমিটার এগোতে না এগোতে গরু এ বার রাস্তার ওপরে। পাশাপাশি সার দিয়ে দাঁড় করানো, দড়ির শক্ত বাঁধনে কারও নড়ার জো নেই। রাস্তাও এগোয়, বেড়ে চলে গরুও। এ ভাবে প্রায় দেড়-দু’কিলোমিটার এগোনোর পর একেবারেই থেমে যেতে হল। সারি সারি দাঁড়িয়ে সেই সব লজঝড়ে বাহন। আশপাশে তখন শুধু গরু আর গরু। তাদের হাঁকডাক ছাপিয়ে নানা বয়সি মানুষের কলরব। সরু রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িতে গরু বোঝাই হচ্ছে, সে গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছে গোল্লাছুট। তার জায়গায় নতুন গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। সবই অন্য যানবাহনকে খুশি মতো থামিয়ে রেখে।

জায়গাটার নাম সাতমাইল। আগে গরুর হাট বসত শনি-মঙ্গলবার। এখন বসে ফি-দিন। এক ফালি হাট এখন ফুলে ফেঁপে কিলোমিটার দুয়েকে দাঁড়িয়েছে। সাতক্ষীরার এক পুলিশ অফিসার গর্বের সঙ্গে বললেন, এই হাটে হাজির হাজার হাজার গরুর ছবি গুগ্লের উপগ্রহ চিত্রেও দেখা যায়!

গোয়েন্দারা বলছেন কাঁটাতারের বেড়ার কল্যাণে সীমান্তের অন্য এলাকা দিয়ে গরু পাচার অনেকটাই এখন বন্ধ। আর তাতেই সাতমাইল হাটের এই বাড়বাড়ন্ত। ভারত থেকে প্রায় সব গরুই এখন উত্তর ২৪ পরগনার আংরাইল, হাকিমপুর, স্বরূপনগর, কৈজুরি হয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে আসে। পেট্রাপোলের ঠিক নীচে থেকে শার্সা, কলারোয়া, ভোমরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী আর জলা-বাওড়ে এলোমেলো সীমান্ত। গরুর দলকে জলে নামিয়ে ভারত থেকে নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। গোয়েন্দারা বলছেন, গরুর সঙ্গে চালান হয় মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরকও। ভারতের প্রত্যন্ত জায়গায় জাল নোট ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম গরু ব্যবসায়ীর দল। গো-হাটুরে সেজে দিব্যি সীমান্ত পেরিয়ে যাতায়াত করে সাধারণ অপরাধী থেকে ফেরার জঙ্গিরা।

এত গরু, এত বড়-বড় গরু আসে কোথা থেকে? কারা তা আনে?

পুলিশ বলছে, ভারত-বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে এই চক্রের জাল। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বিহার-উত্তরপ্রদেশের গোবলয়ও ছাড়িয়ে হরিয়ানা, রাজস্থান, পঞ্জাব এমনকী মোদীর রাজ্য গুজরাতের গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সস্তায় গরু কেনে এদের লোক। কয়েকটি জায়গায় তাদের এনে জড়ো করা হয়। তার পরে হাজার হাজার গরুর শুরু হয় অনন্তযাত্রা। একের পর এক রাজ্য চার পায়ে হেঁটে পেরিয়ে তারা পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি খামারে। সেখান থেকে গাড়িতে চড়ে সীমান্ত সংলগ্ন জলা এলাকায়।

এই সফরের সঙ্গে বোধহয় আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ তৃণভোজী প্রাণীর ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’-এরই একমাত্র তুলনা চলে। গ্রীষ্মে ঝলসে যাওয়া ঘাসজমি ছেড়ে প্রাণধারণের উপযোগী এলাকা খুঁজে নিতে কুমির ভরা খরস্রোতা নদী, সিংহ ডাকা ঊষর মালভূমির বন্ধুর পথ পেরিয়ে ফি-বছর একটানা কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় আফ্রিকার জঙ্গুলে গবাদি পশুরা।

কিন্তু মোড়কে ভরা হেরোইন না-হয় নজর এড়িয়ে যায়, রসুনের বস্তায় ঢেকে রাখা ফেনসিডিলের বোতল বা বোমা-বন্দুক টহলদারদের ফাঁকি দিয়ে পাচার হয়ে গেল, পাল পাল গরু কী ভাবে সীমান্তরক্ষীদের চোখে না-পড়ে চালান হয়?

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুখে কুলুপ বিজিবি-এর ছোট-মেজো কর্তাদের। বিএসএফ-এর ডিজি দেবেন্দ্র পাঠকের যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আগেভাগেই গরুর সীমান্তযাত্রা না আটকালে জওয়ানদের পক্ষে পাচার বন্ধ করা কঠিন। কারণ পাচারকারীরা গরুর পালকে নদী বা বাওড়ের জলে নামিয়ে দিলে তা ফিরিয়ে আনা টহলদার বিএসএফ জওয়ানদের পক্ষে দুঃসাধ্য।

আর এলাকার বাসিন্দারা যা বললেন, তার মোদ্দা কথাটা হল সীমান্তরক্ষী থেকে নজরদার পুলিশ, রাজনীতিক সবাইকেই টাকায় কিনে নিয়ে চলে গরু ব্যবসায়ীরা। পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলে তাদের কিছু অসুবিধা হয়নি, তবে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় বসার পরে গরু চালান বন্ধ ছিল, তবে তা বড় জোর সপ্তাহ খানেক। বৃদ্ধ এক বাসিন্দা চোখ টিপে বলেন, “রক্ষীরা হয়তো হাওয়া ঠাওর করছিল!” তার পরে অবশ্য সবই স্বাভাবিক। আবার গরু আসছে, ঠিক আগে যেমন আসত। তবে খরচা বেড়েছে বলে গরু ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ করতে শুনেছেন তাঁরা।

গোয়েন্দারা বলছেন, গরুর সঙ্গে ‘আনুষঙ্গিক ব্যবসা’ অর্থাৎ মাদক, অস্ত্র বা জাল টাকার বিষয়টি যোগ হয় পশ্চিমবঙ্গে সীমান্তের আশাপাশের খামারগুলোতেই। মালদহ, মুর্শিদাবাদে এমন খামার থাকলেও সেখান দিয়ে গরু পাচার কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সব চেয়ে বড় খামার বীরভূমে দু’টি ও বারাসত বসিরহাটে কয়েকটি। বিভিন্ন রাজ্য থেকে সেখানে গরু এসে পৌঁছয়। সেখান থেকেই গরু তুলে এনে সীমান্ত পেরোয় ব্যবসায়ীরা। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে এই সব খামারে নজরদারি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা।

গত বছর মনমোহন সিংহ সরকারের শেষ দিকে ঢাকা প্রস্তাব দিয়েছিল, গরু ব্যবসা আইনি করে দেওয়া হোক। পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হোক গরুও। বাংলাদেশ সরকারের যুক্তি, এই ব্যবসা যখন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তখন তা থেকে রাজস্ব আদায় করুক দু’দেশই। উপযুক্ত পরিকাঠামো বসিয়ে গরুর সঙ্গে মাদক-অস্ত্রের চোরাচালানও তা হলে রোখা সম্ভব। কিন্তু ভোটের মুখে আগের সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিজেপি সরকারে আসার পরে এই প্রস্তাব আদৌ দিনের আলো দেখবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ঢাকা।

সুতরাং আধপেটা খাবার আর রাখালের কোঁতকানি খেয়ে ভারতের হাজার হাজার গরুর এই মহাপ্রস্থান যাত্রা চলছে-চলবে।

(শেষ)

anamitra chattopadhyay satkhira nia terrorist activity anandabazar report khagragarh burdwan blast border smuggling Thousand Cows running on road arms-drugs national news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy