আর একটু হলে গোটা নাটক একাই ভেস্তে দিচ্ছিলেন তিনি!
স্পিকার হিসাবে কোথায় জমি বিল প্রত্যাহারের নির্দেশ দেবেন তা নয়, উল্টে, তা পাশ করিয়ে দেওয়ার নির্দেশ! মাথায় হাত পরিচালকের। বিরোধীরা হতভম্ব। তাদের চেয়েও বেশি হতচকিত গোটা ট্রেজারি বেঞ্চ। স্ক্রিপ্ট মিলছে না যে! স্ক্রিপ্ট বলছে, জমি বিল প্রত্যাহার করে নেবেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী। তার বদলে তা পাশ হওয়ার নিদান। প্রত্যেকে এ ওর মুখের দিকে চাইছেন। পরিচালকের প্রম্প্ট। স্লিপ পাঠানো। শেষমেশ ভুল বোঝার অবসান। বাতিল হল জমি বিল।
ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত মাসে সরকার ও বিরোধীদের টানাপড়েনে অচল সংসদে এসে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ— দু’পক্ষের বিতর্কে সংসদে সাধারণ মানুষের সমস্যাই আলোচনা হচ্ছে না। তাই দিল্লির মাটিতে বসুক নকল সংসদ। যার প্রতিনিধিত্ব করবেন তৃণমূলের সাংসদেরা। জমি বিল থেকে জিএসটি, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা থেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের হয়ে আলোচনায় নামুক তৃণমূলের সাংসদেরা। আলোচনার ফল কী হবে, তা-ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বলে দিয়েছিলেন তিনি। আসল সংসদে যাই হোক না কেন, নকল সংসদে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তৃণমূলের নীতিকেই। আলোচনা শেষে প্রত্যাহার করতে হবে জমি বিল।
সেইমতো আজ দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে বসেছিল তৃণমূলের নকল সংসদের আসর। স্পিকার রত্না দে নাগ। বিরোধী পক্ষে ছিলেন মূলত তৃণমূলের লোকসভার সাংসদরা। অন্য দিকে সরকার পক্ষের হয়ে দলের তিন রাজ্যসভা সাংসদ ছাড়াও অংশ নেয় দিল্লির ফ্রাঙ্ক অ্যান্টনি পাবলিক স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা। যাদের মহড়া দিতে গত দু’দিন ধরে পরিচালকের ভূমিকায় ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন।
সংসদে ধর্না-বিক্ষোভ ও অচলাবস্থাকে কটাক্ষ করতেই এই উদ্যোগ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল নকল সংসদের অধিবেশনের শুরুতেও ওয়েলে বিক্ষোভ দেখাতে নেমে পড়েন তৃণমূল সাংসদরা। যার জেরে দশ মিনিটের বিরতি। বিক্ষোভের ব্যাখ্যায় সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের যুক্তি, এক দিকে পড়ুয়াদের কাছে সংসদের আসল ছবি তুলে ধরা। অন্য দিকে সেই পড়ুয়া তথা ট্রেজারি বেঞ্চের প্রতিনিধিদের বোঝানো, সরকারের জনবিরোধী নীতি এত সহজে মেনে নেবে না বিরোধীরা। নতুন করে সংসদ বসলে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর। ওঠে কালো টাকা, জিএসটি প্রসঙ্গ। যোগ দেন সাংসদ শতাব্দী রায়-প্রতিমা মণ্ডলেরা। প্রধানমন্ত্রীর স্থানটি অবশ্য শূন্যই ছিল। তিনি অধিকাংশ সময় বিদেশে থাকেন— সেই প্রসঙ্গকে কটাক্ষ করে তির্যক মন্তব্য করেন বিরোধীরা।
নিয়ম মেনে এর পর বিল পেশ। শুরু হয় জমি বিল নিয়ে আলোচনা। ইউপিএ আমল থেকেই এ নিয়ে সংসদে সরব সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ নকল সংসদেও দলের নীতির পক্ষে তাঁর সওয়াল, কেন্দ্রের আইন ভ্রান্ত। কৃষকবিরোধী। জমি না নিলে কী ভাবে শিল্প হবে বলে সরকার পক্ষ যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত স্পিকারের ভুল বোঝাবুঝির পালা সাঙ্গ করে স্ক্রিপ্ট মেনে জমি বিল প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এর পর শুরু হয় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা। যোগ দেন সুলতান আহমেদ ও সৌগত রায়েরা।
গোটা অনুষ্ঠানটি যে ভাবে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয় ভাবে অংশ নেন তাতে মুগ্ধ বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা। সরকার পক্ষে বসলেও, পড়ুয়াদের বলার সুযোগ করে দেন রাজ্যসভা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়। তাঁর মতে, ‘‘অভাবনীয়। যে ভাবে সাংসদদের বক্তব্য এরা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে তা প্রশংসনীয়।’’ আর স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অভিন্দ্র ভার্মার মতে, ‘‘বাস্তব অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকল এই পড়ুয়ারা। এমন সুযোগ সচরাচর পাওয়া যায় না।’’ আর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায় থাকা রিচা তো বলেই ফেললেন, ‘‘এক বার সত্যি সংসদটা ঘুরে আসতে হবে।’’ যার কথায় গলা মেলায় পড়ুয়ার দল।
বাড়ি ফেরার তাড়ায় শেষে আধ ঘণ্টা আগেই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করতে হল স্পিকারকে। স্ক্রিপ্ট গুলিয়ে ফেললেও অধিবেশন দ্রুত শেষ হওয়ায় শেষমেশ স্বস্তি সব পক্ষেরই।