Advertisement
২৬ মার্চ ২০২৩

গরিবের টাকা নিয়ে এজেন্টের ‘ডান্ডি অভিযান’

স্বাধীনতারও কত আগে বিহারের তাৎমাটুলির ঢোঁড়াইয়ের কথা লিখেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। এত বছর পরে ঝাড়খণ্ডের বেতলা অরণ্যের লাগোয়া জনজাতি পরহয়াদের গ্রাম বহুবারিয়ায় এলে তিনি দেখতে পেতেন, সময় কার্যত একই জায়গায় থমকে আছে।

 সুরতি দেবী। ছবি: সৈকত চট্টোপাধ্যায়

সুরতি দেবী। ছবি: সৈকত চট্টোপাধ্যায়

সুব্রত বসু
বেতলা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:৪২
Share: Save:

বছর পঁচিশের সুরতি দেবী হাঁটাচলা করতে পারেন না।

Advertisement

গেঁটে বাতে দু’‌টো পা-ই বেঁকে গিয়েছে। স্বামী মনোজ পরহয়াকে রাজরোগে ধরেছে। শহরের টিবি হাসপাতাল থেকে এক বার ওযুধ এনেছিলেন। গাড়ি ভাড়ার টাকার অভাবে আর যাওয়া হয়নি। দুই মেয়ে পূজা আর সরস্বতীর বয়স ১০ আর আট বছর। সরকারি প্রকল্পের এক টাকা দামের চাল এনে, রান্না করে ভরা যৌবনের বাবা-মাকে নুন-ভাত খাওয়ায় দুই শিশুকন্যা।

স্বাধীনতারও কত আগে বিহারের তাৎমাটুলির ঢোঁড়াইয়ের কথা লিখেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। এত বছর পরে ঝাড়খণ্ডের বেতলা অরণ্যের লাগোয়া জনজাতি পরহয়াদের গ্রাম বহুবারিয়ায় এলে তিনি দেখতে পেতেন, সময় কার্যত একই জায়গায় থমকে আছে।

সুরতি দেবীর মতো যৌবনেই পঙ্গু হয়ে যাননি পাশের আখাড়া গ্রামের অঘোনিয়া দেবী। সাতটি সন্তান নিয়ে এখন তাঁকেই একা সংসার ঠেলতে হয়। স্বামী বিশ্বনাথ বছর দুয়েক আগে যক্ষ্মায় মারা গিয়েছেন। বিধবা পেনশনের জন্য ছোটাছুটি করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন অঘোনিয়া দেবী। বাঁচার ভরসা এখন বেতলার জঙ্গল। ‘কোর’ এলাকায় ঢুকে হাতির পালের নজর এড়িয়ে এক বান্ডিল কাঠ এনে বাজারে বেচলে মেলে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তার জন্য হাঁটতে হয় প্রায় সাত কিলোমিটার। রেশনের এক টাকা দামের প্রায়-অখাদ্য চাল খাতায়-কলমে মেলে হপ্তায় ৩৫ কিলোগ্রাম। অঘোনিয়া দেবী বলেন, ‘‘তার মধ্যে তিন কেজি চাল কেটে নেয় ডিলার। বাকিটা দিয়ে সংসার চলে না। তাই কাঠ বেচা টাকা দিয়ে চালও কিনতে হয় বাজার থেকে ২২ টাকা কেজি দরে। এ বার বুঝে নিন, কী করে বেঁচে আছি।’’

Advertisement

বহুবারিয়ার সুরতি দেবী বা আখাড়ার অঘোনিয়া দেবীর মতো এলাকার সব পরিবারের অবস্থাই কমবেশি এক রকম। শিশুদের বেশির ভাগই এই শীতেও খালি গায়ে বা নামমাত্র পোশাকে ঘুরছে। বড়রাও প্রায় তা-ই। বহুবারিয়ার পঞ্চায়েত সদস্য রাজেন্দর পরহি বলেন, ‘‘আদিবাসীরা দীর্ঘ লড়াই করে তৈরি করেছিলেন ঝাড়খণ্ড রাজ্য। ভেবেছিলেন, এ বার তাঁরা পেট ভরে খেতে পাবেন, পাবেন চিকিৎসা ও শিক্ষা। বিকাশ আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।’’ খোলসা করে বললেন রাজনাথ কুমার।

অরণ্যের পাশের জমিতে এক-আধটু চাষ করে ফসল ফলান বাসিন্দারা। কিন্তু হাতির সংখ্যা এখন এত বেড়েছে যে, সেই চাষ প্রায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আখাড়া গ্রামের সীতানাথ বলেন, ‘‘ফসল পাকলেই হাতির দল এসে খেয়ে নেয়। আগে এ অবস্থা ছিল না। আমার ছেলে শিবনাথ বাধা দিতে গিয়েছিল। হাতির দল ওর প্রাণটাই কেড়ে নিল। ফসল গেলেও ক্ষতিপূরণ মেলে না, জীবন গেলেও না।’’

ক্ষতিপূরণ বা সরকারি প্রকল্পের টাকার কথা উঠতেই সকলের জবানিতে ঘুরে ফিরে আসছিল একটাই শব্দ— ডান্ডি। সেটা কী?

সতীনাথ লিখেছিলেন গানহীবাবার (গাঁধীবাবা) কথা। তাঁর ডান্ডি অভিযানের কথা উঠছে নাকি? হেসে ফেললেন রাজেন্দররা। দাঁড়িপাল্লার ডান্ডা হেলিয়ে প্রতারণা থেকে চালু হয়েছে শব্দটি। পরে শুধু প্রতারণায় সীমাবদ্ধ না-থেকে ‘কাটমানি’ থেকে শুরু করে সব রকমের জুয়াচুরিকে এখানে ‘ডান্ডি’ বলা হয়। আর প্রায় নিরক্ষর আদিবাসী মানুষকে প্রতি পদে যুঝতে হয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের ডান্ডির সঙ্গে।

সীতারাম যেমন বলেন, ‘‘সরকারি টাকা পেতে গেলেই ডান্ডি কেটে নিয়ে বাকিটা দেওয়া হয়। সরকারি এজেন্ট ঋণের কাগজে টিপছাপ নিয়ে আমাদের অনেককেই মাথাপিছু ১৬ হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছে। পরে শোধ করার সময় জেনেছি, ওটা ২০ হাজারের ঋণ ছিল। চার হাজার টাকা ডান্ডি দিতে হয়েছে।’’ রাজেন্দর বলেন, ‘‘শুধু সরকারি প্রকল্পের টাকা নয়, এখন ব্যাঙ্ক থেকে নিজের টাকা তুলতে গেলেও ডান্ডি দিতে হচ্ছে।’’ কী রকম? রাজেন্দর জানান, গাঁয়ের কিছু ছেলে শহরে দিনমজুরি করে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা পাঠান। কিন্তু মেয়ের বিয়ে বা অন্য কাজে ১০ হাজার টাকার বেশি একসঙ্গে তুলতে গেলেই ‘না’ বলে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটাই নাকি সরকারি নিয়ম। কিন্তু এজেন্টকে ডান্ডি দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই টাকা মিলছে।’’ সরকারি এজেন্ট? সরকারের তো এমন কোনও এজেন্ট নেই। গ্রামবাসীদের দাবি, সরকারি অফিস বা ব্যাঙ্কের এক স্তরের কিছু কর্মী এই ‘ডান্ডি’ নেন।

তবে এই গ্রামে এলে কয়েকটা পরিবর্তন দেখতে পেতেন ঢোঁড়াই-স্রষ্টা। ১) গ্রামের মধ্যে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। অনেক কুঁড়ের সামনে লাগানো একশো ওয়াটের বাল্‌ব। ২) বেশ কিছু দরজা-জানলাহীন কংক্রিটের বাড়ি। ৩) সরকারি প্রকল্পে সদ্য তৈরি হওয়া একটি সৌরবিদ্যুৎ চালিত জলের ট্যাঙ্ক।

পঞ্চায়েত সদস্য রাজেন্দর বলছিলেন, ‘‘অনেক লড়াইয়ের পরে জলের ট্যাঙ্কটা নতুন হয়েছে। সরকারি যোজনায় বিদ্যুৎ এসেছিল। সেই কবে এক হোলির আগে ট্রান্সফর্মার ফেটে গেল। আর সারানো হয়নি। এখন রেশন দোকানে ১০০ টাকা দিয়ে মাসে দু’লিটার কেরোসিন পাই। তা-ই দিয়ে চালাতে হয়। আর ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় তৈরি ওই কংক্রিটের কুঠুরি সব ভেঙে পড়ে আছে। ভিতরে ঢুকতেও ভয় করে। আমরা মাটির ঘরেই ফিরে এসেছি।’’

বিকাশের এই ‘ডালি’-ই এ বারের বিধানসভা ভোটে ‘ভরসা’ ঝাড়খণ্ডের শাসকদের। বিরোধীদেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.