ভাষাশহিদ দিবস উপলক্ষ্যে আজও নানা অনুষ্ঠান হল শিলচরে।
আর্য সংস্কৃতি বোধনী সমিতি ১০ বছর ধরে বাংলা তারিখে দিনটি পালন করে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ছিল ৫ জ্যৈষ্ঠ। সেই হিসেবে এ দিনই তাঁরা ভাষাশহিদদের স্মরণ করে। সংক্ষিপ্ত, ছিমছাম অনুষ্ঠানে নাচ, গান, আবৃত্তি হয়। দুপুর ২টো ৩৫ মিনিটে নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সবাই।
সমিতির মুখ্য আহ্বায়ক গৌতম ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ইংরেজি-বাংলা ক্যালেন্ডারের কোনও সংঘাতের জায়গা থেকে নয়, আমরা উনিশে মে-তেও শহিদ স্মৃতিসৌধে যাই। গত কালও গিয়েছি। তবু মনে হয়, বাংলা ভাষার জন্য যারা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের বাংলা তারিখেই শ্রদ্ধা জানানো উচিত।’’
আগে পৃথক ভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করত আর্য সংস্কৃতি বোধনী সমিতি। এখন ‘ভাষাশহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি’ চার দিনের কর্মসূচিতে বাংলা তারিখকেও জুড়েছে। তাই স্মরণ সমিতির মঞ্চেই অনুষ্ঠান করেন গৌতমবাবুরা। নিলয় পাল, রবি বসু সহ স্মরণ সমিতিরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
স্মরণ সমিতির নিজস্ব অনুষ্ঠান হিসেবে এ দিন সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমবেত সঙ্গীত, গানে গানে উনিশের ডাক, কলকাতার এরিনা মুখার্জি-শীর্ষেন্দু রায়ের গান, বাংলাদেশের নৃত্যশৈলী-র অনুষ্ঠান। ১৭ মে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদেরও এ দিন পুরস্কৃত করা হয়।
গত কাল একই মঞ্চে রক্তদান নামে একটি বইয়ের আবরণ উন্মোচন হয়। রক্তদান আন্দোলনের সর্বভারতীয় ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ তার লেখক। উন্মোচন অনুষ্ঠানে লেখক ছাড়াও মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা গৌতম রায়, কাছাড়ের জেলাশাসক গোকুলমোহন হাজরিকা উপস্থিত ছিলেন।
বরাকের ভাষা সংগ্রামের কবেই পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে। ঘটা করে উদযাপনের বয়স পঁচিশ ছোঁয়নি এখনও। প্রথম কয়েক বছর ভাষাশহিদ দিবস পালিত হয়েছে অনাড়ম্বর পরিবেশে। বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে ১১ শহিদকে একসঙ্গে মালা দিতে ১১ জন জড়ো হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ভুগতে হতো— গত কাল দাবদাহ উপেক্ষা করে সকাল থেকে শহিদ স্মরণে লোকের ভিড় দেখে এমন মন্তব্য শোনা যায় মিলনউদ্দিন লস্কর, পরিতোষ দে-র মুখে। তাঁরা বললেন, ‘‘এখন ভিড় ঠেলে গাঁধীবাগ স্মৃতিসৌধেযেতে হয়। তবু লোকজনের উপস্থিতি আমাদের গর্বিত করে। যত বেশি মানুষ বেরিয়ে আসবেন, তত উনিশের কথা ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে।’’ এখন তা খুব জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।
একই কথা শোনালেন রাধামাধব রোডের ৮৭ বছরের বৃদ্ধ কামাখ্যাপ্রসাদ পাল। কোমরে চোট, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাচলা। গত কাল ভিড় এড়িয়ে নীরবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শ্মশানঘাটের শহিদবেদীতে। তিনি বললেন, ‘‘প্রতি বছর আসি। আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম না বটে, কিন্তু চোখের সামনে দেখেছি একসঙ্গে ১১টি চিতা দাউদাউ করে জ্বলছে। আওয়াজ উঠছে, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ। তাই দিনটি এলে স্থির থাকতে পারি না। আগে তেমন কেউ আসত না, তখনও এই দিনটিতে একবার ঘুরে যেতাম।’’
প্রচারের আলোর ধার ধারেননি ৬১-র আন্দোলনের সৈনিক, গুরুচরণ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সঞ্জয় দাসও। নিজের মত করেই এক বার শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে যান।
লোকগবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘আমাদের সামনে দু’ধরনের সঙ্কট। বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের। এনআরসি, বিদেশি, অসমিয়ার সংজ্ঞা ইত্যাদি বহিরঙ্গের সমস্যার সঙ্গে সকলের পরিচয় রয়েছে। কিন্তু অন্তরঙ্গের সমস্যাও কম গভীর নয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার প্রতি নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর কারণ, আমরা তাঁদের উপযোগী লেখা লিখতে পারছি না।’’ তিনি বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস লেখার জন্য গবেষকদের আহ্বান জানান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy