Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

গর্জাল, বর্ষাল না ধর্ম সংসদ

শরিক শিবসেনার হুমকি, ‘মন্দিরের দিন ঘোষণা না করলে বিজেপি সরকারে আসবে না।’ তবে দাবি-হুমকি না মানলে কী পদক্ষেপ, তা নিয়ে এ দিন অন্তত মুখ খুলল না কেউই।

সারা দেশ থেকে অযোধ্যায় হাজির তিন লক্ষ ‘রামভক্ত’। ছবি: পিটিআই।

সারা দেশ থেকে অযোধ্যায় হাজির তিন লক্ষ ‘রামভক্ত’। ছবি: পিটিআই।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
অযোধ্যা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৫৬
Share: Save:

তর্জন-গর্জনের পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ধর্ম সংসদ’-এ বর্ষণ হল ছিটেফোঁটাই।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাল ঠুকে বলল, ‘অধ্যাদেশ আনো। মন্দির বানাও!’ আর শরিক শিবসেনার হুমকি, ‘মন্দিরের দিন ঘোষণা না করলে বিজেপি সরকারে আসবে না।’ তবে দাবি-হুমকি না মানলে কী পদক্ষেপ, তা নিয়ে এ দিন অন্তত মুখ খুলল না কেউই।

তবে অযোধ্যাবাসী বিরক্ত। রামভক্তদের পিলপিলে ভিড়ে তাঁরা অতিষ্ঠ। প্রশাসন দোকান বন্ধ রাখায় ব্যবসা চৌপাট। তার মধ্যেই ১৯৯২-এ মারমুখী করসেবকদের আতঙ্ক উস্কে ওঠায় এলাকা ছাড়ছেন অযোধ্যা-ফৈজাবাদের বহু সংখ্যালঘু পরিবার।

লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যত প্রশ্নের আঙুল উঠছে, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনকে তুঙ্গে তুলে হিন্দু ভোট সংহত করার কৌশল নিচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার। গত কয়েক মাসে রাম মন্দির নিয়ে উন্মাদনা তৈরির পিছনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ধর্ম সংসদ’-এর বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে মন্দির নির্মাণের দাবি জোরালো হলে হিতে-বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও দেখছে বিজেপি শিবির। তাই রবিবারের কর্মসূচির আগের রাতে তড়িঘড়ি সরযূ তীরে বিশ্বের উচ্চতম রামের মূর্তির নকশায় অনুমোদন দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের মন্ত্রিসভা।

রাম মন্দির নিয়ে অযোধ্যায় আজ ‘ধর্ম সংসদ’ ডেকেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। কর্মসূচির শেষে ভিএইচপি-র পক্ষ থেকে দু’টি দাবি রাখা হয়েছে। সংগঠনের উপাধ্যক্ষ চম্পত রায় জানান— এক, গোটা জমিতেই রামের মন্দির বানাতে হবে। মসজিদকে কোনও জমি ছাড়া যাবে না। আর দুই, শীতকালীন অধিবেশনে মন্দির নির্মাণের জন্য অধ্যাদেশ আনতে হবে সরকারকে। দাবি পূরণ না হলে কী হবে, তা অবশ্য বলেননি তিনি। কিন্তু কনৌজের ভিএইচপি নেতা পঙ্কজ দুবের ঘোষণা— এর আগে বিজেপি দশ বছর বনবাসে গিয়েছিল। এ বারেও মন্দির না-হলে তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য অজ্ঞাতবাসে যাবে। সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবতও এ দিন বলেন, সরকারের উচিত মন্দির নির্মাণের জন্য আইন তৈরি করা। অযোধ্যায় এসে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরেও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন মোদীকে।

তবে ‘ধর্ম সংসদ’-এর এই দাবির পরেও কেন্দ্রের প্রভাবশালী মন্ত্রী পীযূষ গয়াল এ দিন জানিয়েছেন, ‘‘সরকারও চায় মন্দির হোক। তবে তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।’’ চাপে পড়ে আজ ভোট প্রচারে মুখ খুলেছেন মোদী। অলওয়ারে অভিযোগ করেছেন, ‘‘লোকসভা ভোটের আগে যাতে রাম মন্দিরের শুনানি না হয়, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিচ্ছে কংগ্রেস। তারা বিচার ব্যবস্থাকে ভয় দেখাচ্ছে!’’ পাল্টা জবাবে কংগ্রেসের কপিল সিব্বল বলেন, ‘‘বিষয়টিকে নির্বাচনের হাতিয়ার করছে সরকার। তবে তাদের সমর্থকেরাই এখন সেই খেলা ধরে ফেলেছে।’’
ক’দিন ‌ধরেই উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছিল অযোধ্যা। ‘ধর্ম সংসদ’ উপলক্ষে দুর্গের চেহারা নেয় গোটা শহর। আজ সকাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় রাম জন্মভূমি-মুখী সব রাস্তা। মোড়ে মোড়ে নাকা, খাকি আর জলপাই উর্দির ছড়াছড়ি। দোকানপাট বন্ধ। ছাড় শুধু চায়ের দোকান।
পাহারা সত্ত্বেও সকাল সাড়ে দশটাতেই হনুমানগড়ীর মুখে ভক্তদের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে। ভিড়কে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ওয়াকিটকি-তে নির্দেশ দিতে থাকেন দায়িত্বে থাকা এডিজি এ আনন্দ। হলে কী হবে, বেনারসের মতোই এ-গলি-সে গলি দিয়ে পৌঁছে যাওয়া ভিড়ের একমাত্র লক্ষ্য তখন হনুমানগড়ী হয়ে রামলালা দর্শন। বাধ্য হয়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় দর্শন। প্রস্তুত রাখা হয় জল কামান। হইচই চিৎকারে কান পাতা দায়।
আর এ সবে তিতিবিরক্ত অযোধ্যাবাসী। রাম জন্মভূমির পাশে নিউ বাজারে বই-খাতার দোকান পান্নালাল সোনির। বিক্রি-বাটা চুলোয়। তবু মনে আশা, ‘‘এক বার মন্দির হলে বহু মানুষ দেখতে আসবেন। তখন বাড়তি লাভ করে না হয় পুষিয়ে দেব।’’ উল্টো মতও রয়েছে। আধা পাল্লা খোলা রেখে মেয়ে কোলে ভিড় দেখছিলেন সুশান্ত শাহ। মূর্তি ফটো, প্রসাদ, ধূপকাঠির দোকান। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কার্তিক পূর্ণিমার মেলার শেষ দিনে আজ বিক্রিবাটা হয়। এ বার দোকানের সামনে কাউকে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না পুলিশ!’’ আবার ধরম কাঁটা, কাজিয়ানা, কাটরা-র মতো সংখ্যালঘু এলাকায় অস্বস্তির ফিসফাস। তরুণী সালেয়া জানালেন, অনেকেই সেই ৯২-এর ডিসেম্বরের কথা বলছেন। বললেন, ‘‘মহল্লার অনেক পরিবার এলাকা ছেড়েছেন। কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন, কেউ গিয়েছেন অন্য শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে।’’ অটো চালক শরিফের স্বগতোক্তি— ‘‘অ্যায়স্যাই ললকার থা উস বারও!’’
বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে পুলিশ থেকে ভক্ত সকলকেই নিখরচায় চা খাওয়াচ্ছেন চিন্ময়ানন্দ। কিন্তু দিনের শেষে ধর্ম সংসদের মনোভাব দেখে হতাশ তিনি। বললেন, ‘‘সেই তো সময় দেওয়া হল। এ ভাবে আর ক’দিন।’’ হতাশ দোকানি পরশনাথও। বেনারসি পান বানানোর ফাঁকে বললেন, ‘‘মন্দির নিয়ে দেশের মুখিয়া চুপ থাকলে এমনটাই হবে!’’ তখনও তাঁরা জানেন না, এ দিন মুখ খুলেছেন মোদী।
আর যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই রামলালার দর্শন পেলাম পড়ন্ত বিকেলে। ছয় দফা তল্লাশি শেষে, লোহার জালের ব্যারিকেডের পিছন থেকে। চুপটি করে বসে রয়েছেন অস্থায়ী আসনে। সিআরপি-র মহিলা বাহিনীর কড়া পাহারায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE