কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যান এবং তাঁর বক্তব্যে দেশ উত্তাল। কিন্তু, সমস্যা হল এই বক্তব্যে কি সত্যিই মন্ত্রীর অন্য কিছু বলার মতো ছিল?
তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একাধিক রিপোর্ট। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তৈরি করা সেই রিপোর্টে তো তেমনটাই বলা হয়েছে, যেমনটা বলেছেন মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে।
সেখানেই প্রশ্ন উঠছে, ওই ব্যুরোর তৈরি করা রিপোর্টের বাস্তবতা নিয়েই। আসলে কোনও রকম ভাবে কোনও পরিসংখ্যান দিতে গেলে তো ওই রিপোর্টের উপরই নির্ভর করতে হবে। কিন্তু চোখে দেখা বাস্তবটা যে একেবারে ভিন্ন। তাই এত সমস্যা।
এনসিআরবি জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কৃষক আত্মহত্যার হার কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। ২০০৯-এ যেখানে ১৭ হাজার ৩৬৮ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছিলেন, ২০১৪-এ সেই সংখ্যা দেখানো হয়েছে মাত্র ৫,৬৫০। সম্প্রতি এনসিআরবি তাদের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। সেখানে কৃষক এবং ভাগচাষিদের সম্পূর্ণ পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আত্মহত্যাকারী কোনও কৃষিজীবীর যদি নিজের নামে বা তাঁর বাবার নামে জমি না থেকে থাকে তবে তিনি কৃষক নন। তা হলে তাঁর আত্মহত্যাও বিবেচিত হল সাধারণ আত্মহত্যা হিসাবে। এই হিসাবে ভারতবর্ষে মহিলা কৃষিজীবীরও ‘কৃষক’ পরিচিতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক জন কৃষিজীবী মহিলা পরিচিত হন ‘চাষি-বৌ’ বলে।
তাই তাঁদের আত্মহত্যার কারণ হিসাবেও উঠে এসেছে কৃষির বাইরের নানা প্রসঙ্গ। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহ তাই জানিয়েছেন, ২০১২-’১৩ সালে মোট যত জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন তার মাত্র সাত শতাংশের কারণ কৃষি সঙ্কট। আর ২০১৪ সালে মাত্র ২২ শতাংশ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন কৃষি সমস্যার কারণে। কৃষিমন্ত্রী তাঁর লিখিত জবাবে জানান, চাষিদের কেউ ভালবাসায় দাগা খেয়ে, কেউ বা বিয়ে ভেঙে যাওয়া বা যৌন অক্ষমতার মতো কারণে আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে আত্মহত্যা করেছেন ড্রাগের নেশা, পারিবারিক বিবাদ বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে। আমরা ধরেই নিতে পারি এ হিসাব তিনি পেয়েছেন এনসিআরবি-র রিপোর্ট থেকেই।
কিন্তু, আইবি-র দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ২০.৬ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে, ২০.১ শতাংশ পারিবারিক সমস্যার কারণে, ১৬.৮ শতাংশ ফসলহানির জন্য। এমনকী, আইবি খুব সম্প্রতি মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা ও কর্নাটক ও পঞ্জাবের পরিস্থিতি নিয়ে চিঠিও দিয়েছিল মোদী সরকারের কাছে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, কৃষকদের আত্মহত্যার কারণ এক দিকে যেমন প্রাকৃতিক, তেমনই তা অনেকাংশে সরকারি নীতির উপরও নির্ভরশীল। তাদের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট— সরকারি সাহায্য প্রকল্প থাকলেও তা কৃষকদের জন্য যথেষ্ট নয়। আজও গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ কৃষক নির্ভর করেন স্থানীয় মহাজনদের উপর। ফলে তাঁদের সুদ দিতে হয় ২৪ থেকে ৫০ শতাংশ হারে।
তার পরেও এমন রিপোর্ট বা মন্ত্রীর বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু, কী করে এনসিআরবি এ ভাবে রিপোর্ট তৈরি করল? এক আধিকারিক বেশ কয়েক দিন আগে নিজেই জানিয়েছিলেন, আসলে তাঁদের নির্ভর করতে হয় স্থানীয় থানা ও রাজ্য সরকারের পাঠানো রিপোর্টের উপর। সেই বিশ্বাসযোগ্যতাই তো থাকছে না।
যেমন ধরা যাক দু’টি রাজ্যের কথা— ছত্তীসগঢ় ও পশ্চিমবঙ্গ। ২০১১ সালে ছত্তীসগঢ় যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল মোট ৪,৭০১ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছে। কিন্তু, তার পরের তিন বছরে কোনও কৃষক আত্মঘাতী হয়নি বলেই তারা দেখিয়েছে। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গও ২০১২ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল, ২,৮৫৪ জন কৃষক আত্মঘাতী বলে। কিন্তু তার পর থেকে সে রিপোর্টের খাতায় শূন্য অঙ্ক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy