Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Jayalalithaa

জয়ার জীবনে এমজিআর কি শুধুই ‘মেন্টর’ ছিলেন

ভরদুপুরের থর মরুভূমি। ধুধু বালির গায়ে রোদের গনগনে তাপ লেগে রয়েছে। খালি পায়ে সেই বালিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। পা পুড়ে যাচ্ছে! কিশোরীর শরীরী সেই যন্ত্রণা ফুটে উঠছে চোখে, মুখে, গোটা শরীরে। সামনের ক্যামেরা সেটাই ধরে রাখতে চায়।

সিলভার স্ক্রিনে।— ফাইল চিত্র।

সিলভার স্ক্রিনে।— ফাইল চিত্র।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৪:২০
Share: Save:

ভরদুপুরের থর মরুভূমি। ধুধু বালির গায়ে রোদের গনগনে তাপ লেগে রয়েছে। খালি পায়ে সেই বালিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। পা পুড়ে যাচ্ছে! কিশোরীর শরীরী সেই যন্ত্রণা ফুটে উঠছে চোখে, মুখে, গোটা শরীরে। সামনের ক্যামেরা সেটাই ধরে রাখতে চায়। তাই, জুতো পরা যাবে না। শুটিং চলতে থাকে।

ক্যামেরার আশেপাশে অন্য মানুষগুলোর কিন্তু পায়ে জুতো রয়েছে। জুতো রয়েছে নায়কের পায়েও। ক্যামেরার সামনে গরম বালিতে খালি পায়ে শুধু ক্রীতদাসীর চরিত্রে অভিনয় করা কিশোরী নায়িকা। জয়রাম জয়ললিতা। নায়কের ভূমিকায় তাঁর থেকে প্রায় বছর পঁয়ত্রিশের বড় এমজি রামচন্দ্রন। বাকি দুনিয়া যাঁকে তত দিনে এমজিআর নামে চেনে। ইউনিটের কাউকে মুখ ফুটে যন্ত্রণার কথা বলতে পারছিলেন না জয়া। হাবেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এমজিআর-কে। নায়ক বুঝেও গেলেন। চিত্কার করে উঠলেন, ‘প্যাক আপ’।

ক্যামেরা বন্ধ। কিন্তু, নায়িকার স্বস্তি কোথায়! তাঁকে তো ওই তপ্ত বালুরাশিতে পা ডুবিয়েই গাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে! এগোতে আর পারছেন না। চোখ-মুখ কুঁচকে, পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই কোনও রকমে পা টেনে টেনে হাঁটছেন। হঠাত্ই পিছন থেকে দু’হাতে পাঁজা করে তাঁকে নিজের কোলে তুলে নিলেন এমজিআর। তার পর সোজা গাড়িতে। যন্ত্রণার মধ্যে এমজিআর-এর এই যত্নশীল ভূমিকা নিশ্চয়ই কিশোরী মনে প্রভাব ফেলেছিল? জবাব অজানা।

এই জয়ললিতাই পরবর্তীতে এমজিআর-এর অসংখ্য ছবির নায়িকা হবেন। রাজনীতিতে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হবেন। একাধিক বার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হবেন। মৃত্যুর পরে সেই এমজিআর-এর পাশেই সমাহিত হবেন। এই দুই মানুষের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা তো হবেই! হয়েওছে। হচ্ছেও। উত্তাল হয়েছে দক্ষিণের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। এমনকী, রাজ্য রাজনীতিও তোলপাড় হয়েছে। আর তত দিনে ‘আম্মু’ থেকে ধীরে ধীরে ‘আম্মা’ হয়ে উঠেছেন দক্ষিণী ছবির সুপার স্টার জয়রাম জয়ললিতা।

মঞ্চে তখন জয়া (বাঁ দিকে) এবং এমজিআর ।— ফাইল চিত্র।

চলতি বছরের মার্চে ‘জাগারনাট’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘আম্মা: জয়ললিতা’স জার্নি ফ্রম মুভি স্টার টু পলিটিক্যাল কুইন’। লেখিকা বিশিষ্ট সাংবাদিক বাসন্তী। দু’বছরের ‘আম্মু’ যখন তার ভাই ‘পাপ্পু’র সঙ্গে সদ্য পিতৃহারা হয়েছে, ঠিক সেই সময় থেকেই লেখিকা শুরু করেছেন। তার পর অনেকটা পেরিয়ে এমজিআর-জয়া সম্পর্ক নিয়ে শব্দ বুনেছেন। সেই বুনোটের ছত্রে ছত্রে রোমান্স বাসা বেঁধেছে। অথচ, ভীষণ ধীর লয়ে। এক জন কিশোরী কী ভাবে সহ-অভিনেত্রী থেকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছিলেন, সে কথাও শুনিয়েছেন বাসন্তী।

এমজিআর তত দিনে গোটা দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছেন জয়ললিতার প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রযোজকদের উপর তিনি প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। যাতে, তাঁর বিপরীতে জয়ললিতাকে নায়িকা হিসাবে নেওয়া হয়। যাঁরা রাজি হতেন না, তাঁদের তিনিও ঘোরাতেন। জয়ললিতা যদিও প্রযোজক, পরিচালকদের প্রতি যথেষ্ট সম্ভ্রম দেখিয়েই চলতেন। এমজিআর-এর প্রতিও তাঁর দুর্বলতা কখনও প্রকাশ্যে আনেননি। তবে, তিনি যে এমজিআর-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল তা বোঝা যেত।

এক বার উপোস করে বাড়িতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন জয়ললিতা। তাঁর আপ্ত সহায়ক এমজিআরকে খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গেই জয়ার বাড়িতে চলে আসেন এমজিআর। সকলকে সরিয়ে তিনি সোজা জয়ললিতার বিছানার কাছে পৌঁছন। দেখেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার থেকেও উপস্থিত সকলের মধ্যে আসলে একগুচ্ছ চাবি নিয়ে উত্সাহ বেশি। তত দিনে অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম হয়েছে তাঁর। টাকাপয়সাও হয়েছে। ‘চাবি’ কার দখলে থাকবে, তা নিয়েই কাড়াকাড়ি। জয়া বাঁচলেন কি মরলেন, তা নিয়ে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এমজিআর সোজা তাঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান। সঙ্গে চাবিও। পরে জয়া সুস্থ হয়ে উঠলে, সেই চাবি তাঁকে ফেরত দিয়ে দেন। এই ঘটনায় আর এক প্রস্থ শ্রদ্ধা বেড়ে যায় জয়ার।

আরও পড়ুন, শুধু তামিলনাড়ু নয়, দেশের হায়েস্ট পেড অভিনেত্রী ছিলেন জয়া

জয়ার প্রতি এতটাই যত্নশীল ছিলেন এমজিআর যে, রাতের বেলা বাড়ির বাইরে বেরলে তাঁকে গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। জয়ললিতাই দক্ষিণের প্রথম নায়িকা, যাঁর নিজস্ব জনসংযোগ আধিকারিক ছিলেন। বাসন্তীকে তিনি জানিয়েছেন, শুধু রাতে নয়, প্রতি দিন বেলা একটা নাগাদ এমজিআর একটা গাড়ি পাঠাতেন। এক ঘণ্টার জন্য জয়া সেই সময় বেরিয়ে পড়তেন। তবে, দু’জনের এই সম্পর্কে উত্থানপতনও ছিল। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এমজিআর বয়সে তরুণী অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করা শুরু করেন। পাশাপাশি ডিএমকে দলের কোষাধ্যক্ষ হওয়ায় তিনি সব সময় ব্যস্তও থাকতেন। কাজেই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

তত দিনে পোয়েস গার্ডেনে জয়ললিতার বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। এক দিন নতুন বাড়িতে পার্টির আয়োজন করেন জয়া। গোটা ইন্ডাস্ট্রি সেখানে হাজির। শুধু এমজিআর এলেন না। জল্পনা তুঙ্গে। জয়ার পার্টিতে এমজিআর নেই! তবে কি বিচ্ছেদ হয়ে গেল? পরের দিন জয়ললিতা কাশ্মীর যাবেন। শুটিং আছে। বিমানে উঠেই তিনি দেখেন, পাশের আসনে এমজিআর বসে। তাঁরও শুটিং রয়েছে। কাশ্মীরেই। তবে দু’জনের দু’জায়গায়। মাঝে দূরত্ব প্রায় ৪০ মাইল। কাশ্মীরে পৌঁছে গাড়িতে জয়ললিতাকে নিয়ে প্রথমে নিজের শুটিং স্পটে যান এমজিআর। পরে জয়াকে তাঁর স্পটে পৌঁছে দেন। জয়ার কিছু বলার থাকত না এই সব ক্ষেত্রে। এমজিআর যা বলতেন, সেটাই তাঁকে করতে হত। শুধুই কী শ্রদ্ধার জায়গা থেকে? প্রশ্ন উঠেছে।


রাজাজি হলে এমজিআর-এর মাথার কাছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন জয়ললিতা। ছবি: টুইটার।

বেশ কিছু দিন পর জয়ললিতা বুঝতে পারেন, তিনি পুরোপুরি এমজিআর-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেন। তিনি কী পরবেন, কী খাবেন, কোথায় যাবেন, এমনকী তাঁর অর্থনৈতিক বিষয়টিও এমজিআর-ই দেখতেন। জয়ললিতা সেটা ভেঙে বেরতে চাইলেন। কিন্তু, এত সহজে কি সবটা হয়? দু’জনের মধ্যে বড়সড় বিরোধ বাঁধল তখন, যখন এমজিআর-এর সঙ্গে সিঙ্গাপুর যেতে আপত্তি জানালেন জয়ললিতা। ছোটবেলা থেকে তিনি নাচ শিখেছেন। সিনেমা করলেও নাচ তাঁর সঙ্গী। নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। একক নৃত্যও পরিবেশন করেন। সেই সময়ে, একটা নৃত্যনাট্য গোটা বিশ্বে মঞ্চস্থ করে বেড়ানোর পরিকল্পনা করেন। অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের কথা দিয়ে দেন। নেন অগ্রিম টাকাও। জয়ার বিশ্ব সফরের সব কিছু যখন চূড়ান্ত, ঠিক এমন একটা সময়ে ‘বিশ্ব তামিল সম্মেলন’ আয়োজিত হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে এমজিআর প্রধান অতিথি। জয়ললিতাকে তিনি তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা বলেন। বলেন, সিঙ্গাপুর দিয়েই তাঁর বিশ্ব ভ্রমণ শুরু হোক! জয়া প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এমজিআর তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এ বার জোর খাটাতে শুরু করেন। বলেন, তাঁর অনুমতি না নিয়ে বিদেশ সফরে যাওয়া যাবে না। জয়ললিতা ভেঙে পড়েন। রেগেও যান। বিদেশ সফর তিনি বাতিল করেন। শিল্পীদের টাকাপয়সা মিটিয়ে দেন। ভেঙে দেন নিজের নাচের দলও। এমজিআর-এর কাছ থেকে অনুমতি নিতে চাননি তিনি। সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক।

আরও পড়ুন, ২২ কেজি সোনা, বিশাল প্রাসাদ সহ আরও যে সব সম্পত্তি রেখে গেলেন আম্মা

খ্যাতির চূড়ায় থাকা অবস্থাতেই সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন জয়া। প্রায় ১০ বছর তাঁদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিল না। ডিএমকে ভেঙে বেরিয়ে এসে তত দিনে এআইডিএমকে তৈরি করেছেন এমজিআর। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। ১৯৭২ সালে এআইডিএমকে গঠনের প্রায় ১০ বছর পর সেই দলে যোগ দিলেন জয়া। ৮২তে দলে যোগ দেওয়ার পরেই ৮৪তে তাঁকে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠান এমজিআর। কিন্তু, হঠাত্ই ১৯৮৭-তে মারা গেলেন তিনি।

এখানেই সমাহিত করা হবে জয়ললিতাকে (বাঁ দিকে)। অদূরে এমজিআর-এর সমাধি। —নিজস্ব চিত্র।

সে দিন খবরটা পেয়েই জয়া গাড়ি নিয়ে সোজা যান রামভরম গার্ডেন্সে। এমজিআর-এর বাসভবনে। কিন্তু, তাঁকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এ ঘর, ও ঘর দৌড়াদৌড়ি করেও কোথাও এমজিআর-এর দেহ খুঁজে পেলেন না যখন, তখন এক জন তাঁকে বলেন, দেহ রাজাজি হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক ছুট্টে সেখানে পৌঁছন জয়া। দু’দিন ধরে দু’দফায় ১৩ এবং ৮ ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি এমজিআর-এর মাথার কাছে। আর ওই গোটা সময়টাই তাঁকে নানা ভাবে উত্যক্ত করে গিয়েছেন এমজিআর-এর স্ত্রী জানকীর অনুগামীরা। পায়ে চিমটি কেটে, গায়ে ধাক্কা দিয়ে— শত জ্বালাতনেও তাঁকে টলানো যায়নি। মেরিনা বিচে যাওয়ার পথে এমজিআর-এর শেষযাত্রাতেও তিনি লাঞ্ছিত হন। উত্তরসূরি হিসেবে কারও নাম করে যাননি এমজিআর। তাই জয়া খুব একটা সুবিধেজনক জায়গাতে ছিলেন না দলে। শেষে নিজের অনুগামীদের নিয়ে দল ভাঙেন। জয় আসে জয়ার। পরে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। এক বার না, একাধিক বার।

সম্প্রতি জয়া মারা যাওয়ার পরে, তাঁর দেহও সেই অ্যাপেলো হাসপাতাল থেকে বাড়ি হয়ে রাজাজি হলে নিয়ে যাওয়া হয়। মেরিনা বিচে এমজিআর-এর প্রায় পাশেই সমাহিত করা হয় তাঁকে। ফের শুরু হয় জল্পনা। বিষাদের মধ্যেও। জয়ার জীবনে শুধু কি ‘মেন্টর’ই ছিলেন এমজিআর? বাকিটা কি গুজব? না কি জল্পনা?

বাসন্তীর ‘আম্মা: জয়ললিতা’স জার্নি ফ্রম মুভি স্টার টু পলিটিক্যাল কুইন’-এর ছত্রে ছত্রে আছে এই সব প্রশ্নেরই নিটোল জবাব।

ঋণ: আম্মা: জয়ললিতা’স জার্নি ফ্রম মুভি স্টার টু পলিটিক্যাল কুইন, জাগারনাট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jayalalithaa MGR Tamil Nadu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE