Advertisement
১৯ মে ২০২৪

অন্য শপথের ইতিহাস দেখল রাইসিনা

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান? নাকি জনসভা! কিংবা অচলায়তনকে ভেঙে বেরনো! কী বলবেন একে? রাইসিনার এই পাহাড়চুড়োয় এর আগে দেশের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। অথচ সে দিনের থেকে আজকের ফারাক যেন আসমান জমিন!

রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরে তখন শপথগ্রহণ চলছে। ছবি: এএফপি

রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরে তখন শপথগ্রহণ চলছে। ছবি: এএফপি

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৪ ০৪:০৭
Share: Save:

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান? নাকি জনসভা! কিংবা অচলায়তনকে ভেঙে বেরনো!

কী বলবেন একে?

রাইসিনার এই পাহাড়চুড়োয় এর আগে দেশের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। অথচ সে দিনের থেকে আজকের ফারাক যেন আসমান জমিন!

পাঁচ বছর আগে রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোক হলে শপথ নিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। আজ নরেন্দ্র মোদীর অভিষেক মঞ্চ থেকে প্রাসাদের সে ঘরের দূরত্ব মেরেকেটে চল্লিশ মিটার! মূল গম্বুজের নীচে যে হলে শপথ নিয়েছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মঞ্চের ঠিক পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই তো সেই দরবার। তবে ঔপনিবেশিক বাতাবরণ ভেঙে ১৯৯০ এবং ১৯৯৮ সালে সেই দরবার থেকে বেরিয়ে এই উঠোনেই তো শপথ নিয়েছিলেন যথাক্রমে চন্দ্রশেখর ও প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে আজ রাইসিনার উঠোনে যা হল, তা সত্যিই ইতিহাস! সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ছিপছিপে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ হল, আর তার সাক্ষী থাকতে উৎসাহীদের ভিড়, পরিসংখ্যান, আলো, আবহ, উষ্ণতা, জাঁকজমক চুরমার করে দিল সব রেকর্ড।

লুটিয়েন সাহেবের স্থাপত্যের পিছনে সূর্য ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যখন চৌহদ্দিতে ঢুকলেন, স্লোগান উঠল ‘মোদী’, ‘মোদী!’ এক মুহূর্তের জন্য যেন সংশয় তৈরি হল, ওঁর জনসভা নয়তো! অতীতে কোনও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে এমন হয়েছে!

দূরদর্শনের পর্দায় এই শুরুর মুহূর্তটা সরাসরিই সম্প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু সেই শুরুর আগেও আজ একটা শুরু ছিল। বিকেল তিনটে। সূর্য তখনও সমস্ত তেজ ঢেলে দিচ্ছে প্রাণপণে। বাতাসের তাপমাত্রা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তাতে রাইসিনার উঠোনের লাল মাটি তেতে আরও লাল। এক টানা তিন ঘণ্টা সেই ঠা ঠা রোদে বসে থাকলে শরীরের হাল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আজ সে সব কিছুকে পাত্তা দিতে বয়েই গেছে পাঁচ হাজারি ভিড়ের!

শপথ-মঞ্চে মোদী উঠতেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ভিড়ের মধ্যে! পরণে অফ হোয়াইট রঙের কুর্তা। সাদা পাজামা। কুর্তার ওপর তাঁর নিজস্ব কেতার বিস্কুট রঙের হাত কাটা জ্যাকেট। দু’বছর আগে কংগ্রেস প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার পর নর্থ ব্লকে প্রথম শুভেচ্ছা ফোনটি এসেছিল গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। আজ ফের দু’জন মুখোমুখি। শপথ বাক্য পাঠ করানোর সময় প্রথামতো রাষ্ট্রপতিই শুরুটা ধরিয়ে দিলেন, ‘ম্যায়..।’ এবং তার পরেই, “ম্যায় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, ইশ্বর কে নাম পে শপথ লেতা হু...।” মোদীর শপথ উচ্চারণকে ঢেকে দিয়ে আরও এক বার চত্বর ভরে উঠল অনুগামীদের স্লোগানে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোড়ায় দরবার হলেই হতো শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। পরে স্থান পরিবর্তন করে তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অশোক হলে। কারণ দরবার হলে শব্দযন্ত্র ঠিক মতো কাজ করে না। প্রতিধ্বনিত হয়। তাতে সব কথা বোঝা যায় না। শপথগ্রহণ আজ উঠোনে নামিয়ে এনেই বা কী হল? রাইসিনা প্রাসাদের সামনে জয়পুর স্তম্ভের নীচ থেকে উঠে আসা পাঁচ হাজার মানুষের স্লোগান, হাততালি, উন্মাদনার গর্জন বারবার ধাক্কা খেল সাউথ ব্লক, নর্থ ব্লকে।

এবং সেটাই ক্লাইম্যাক্স! চা-ওয়ালা থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে উত্তীর্ণ হলেন তিনি। যাঁকে বিজেপি নেতারা বলেন, ‘লার্জার দ্যান লাইফ।’ আজ শপথগ্রহণের ছবিতেও ধরা থাকল সেই মেজাজটাই।

২৬ মে, সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে দেশের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের আগে যে আবহ আজ তৈরি হয়েছে তিল তিল করে। বেলা তিনটে থেকে আজ রাইসিনায় যে ভিড় জমেছিল, তাকে চাঁদের হাট বললেও অতিশয়োক্তি হয় না! তবে প্রত্যাশিতদের মধ্যে অমিতাভ বচ্চন ছিলেন না। ছিলেন না রজনীকান্ত। অসুস্থ, তাই আসতে পারেননি মোদী অনুরাগী লতা মঙ্গেশকর। ভারতরত্ন সচিন তেন্ডুলকরের অনুপস্থিতিরও নিশ্চয়ই কোনও অনিবার্য কারণ ছিল।

কিন্তু সুনীল গাওস্কর ছিলেন, সলমন খান ছিলেন, ছিলেন তাঁর বাবা তথা চিত্রনাট্যকার সেলিম খান। ছিলেন ধর্মেন্দ্র-হেমামালিনী, হৃতিক রোশন। শিল্পপতিদের মধ্যে মুকেশ ও অনিল অম্বানী, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, কিশোর বিয়ানি, গৌতম আদানি। আবার বাঙালি উদ্যোগপতিদের মধ্যে প্রসূন মুখোপাধ্যায়, সন্দীপ ভুতোরিয়ারাও ছিলেন।

শপথ অনুষ্ঠানে মোদীর প্রবেশের আগেই লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীর মতো বিজেপির প্রথম প্রজন্মের নেতারা এসে পৌঁছন সেখানে। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সাবলীল উপস্থিতি নজর কেড়েছে। দৃশ্যত ম্রিয়মান রাহুল গাঁধীর উপস্থিতিও চোখ এড়ায়নি।

আর সেই গমগমে পরিস্থিতিতেই পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যখন প্রবেশ করেন, তখন হাততালি দিয়ে অভ্যর্থনার দৃশ্যটা ছিল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। যেন ঘরের মাঠে নামছেন নওয়াজ, আর তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছেন গুণগ্রাহীরা! ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই উষ্ণতা শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, হয়তো দু’দেশের বিদেশ সচিবরাও মনে করে বলতে পারবেন না! একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজাপক্ষে ঢোকার সময়েও।

তবে মোদী মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যরা যখন শপথ নিয়েছেন, তখন কিন্তু এই উন্মাদনা নজরে পড়েনি। বিক্ষিপ্ত ভাবে স্মৃতি ইরানি ও উমা ভারতী তবু কিছুটা হাততালি পেয়েছেন। এমনকী উমা ভারতীর শপথগ্রহণের সময় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানও উঠতে দেখা গেছে! কিন্তু ওইটুকুই। বরং সমস্ত উৎসাহ, উত্তেজনা, উন্মাদনা যেন জমা করে রাখা ছিল শুধু তাঁর জন্য। ওয়ান ম্যান শো! তাঁর জনসভায় তো এমনই হয়!

শপথেও হল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sankhadeep das modi bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE