নরেন্দ্র মোদীর শপথ যেন রাজসূয় যজ্ঞ।
এমন এলাহি আয়োজনের সাক্ষী কখনও হয়নি রাষ্ট্রপতি ভবন। অটলবিহারী বাজপেয়ী, চন্দ্রশেখরও রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের মাঠ ফোর-কোর্টে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনের ইতিহাসে ১৫০০ জনের বেশি অতিথি একসঙ্গে কখনও আসেননি। আগামিকাল মোদী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সেই সংখ্যা এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছে ৪ হাজারে। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার আগেই মোদী নিজের শপথ গ্রহণকে করে তুলতে চাইছেন এক মেগা-ইভেন্ট। শুধু দেশে নয়, তিনি রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়ও।
ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও হবু প্রধানমন্ত্রী বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের শপথে থাকার আমন্ত্রণ জানালেন। তার জন্য অবশ্য কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি তাঁকে। আমলাদের উপরে ভরসা না করে মোদী নিজের হাতেই তুলে নেন রাশটি। পরামর্শ নেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়েরও। আটটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতে আসতে শুরু করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষে, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন আব্দুল গায়ুম, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীনচন্দ্র রামগুলাম, বাংলাদেশের স্পিকার শিরিন শরমিন চৌধুরী ও নেপাল-ভূটানের প্রধানমন্ত্রী শপথে যোগ দিচ্ছেন। মোদীর উদ্যোগেই আমন্ত্রণ গিয়েছে সব দেশের রাষ্ট্রদূত, মনমোহন সিংহ জমানার সব মন্ত্রী ও সনিয়া-রাহুল গাঁধীর কাছে। তালিকায় রয়েছেন লোকসভা ও রাজ্যসভার সব সাংসদ, সব সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান, সব মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল। আর রয়েছেন তারকারা। অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্ত, লতা মঙ্গেশকর থেকে আমন্ত্রিত এক সাধারণ চা-বিক্রেতা, যিনি বডোদরায় মোদীর মনোনয়ন পেশের সময়ে নাম সুপারিশ করেছিলেন। খোলা আকাশের নীচে এ এক চাঁদের হাট। তাঁরা সাক্ষী হবেন দেশের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের।
শপথের পরেই মোদী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেখানেও অভিনবত্ব মেনুতে। নওয়াজদের পাতে পড়ছে বাংলার পটলের দোলমা, সন্দেশ। থাকছে গুজরাতের ধোকলা, কড়ি, ডাল মাখনি, মেথি শাক। মোদী নিজে নিরামিষ খান, কিন্তু বিদেশি অতিথিদের জন্য থাকছে চিকেন হাজারভি, গলউটি কাবাব, চিংড়ির স্টু, চিকেন চেট্টিনাড়, মটন শামি কাবাব। শপথের ঠিক পরেই হাই-টি। সেখানে থাকছে কচুরি-মুগ ডাল, শশার স্যান্ডউইচ, নানা ধরনের বিস্কুট, অমৃতি। মেন মেনুতে চিল্ড মেলন স্যুপ, তন্দুরি আলু, কেরলের ভেজ স্টু, বীরবলী কোফতা কারি, জয়পুরি ঢেঁড়শ, স্টিমড রাইস ও নান। মিষ্টিমুখে বাঙালি সন্দেশ ছাড়াও আনারসের হালুয়া, আমের শ্রীখণ্ড, গ্রিন-টি, দক্ষিণ ভারতের কফি। আর শেষ পাতে পান। রাষ্ট্রপতি ভবনের রাঁধুনিরা ২ দিন আগে থেকেই এ সবের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।
রবিবার রাত থেকেই নেমেছে বৃষ্টি। এ দিকে খোলা আকাশের নীচে এই আয়োজনে সামিয়ানার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে চার হাজার অতিথির জন্য দুই হাজার ছাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিরা? রাষ্ট্রপতি ভবনের এক কর্তার মতে, “নিশ্চয়ই এই গরমে কেউ কেউ ভিজতেই পছন্দ করবেন। তবে মুষলধারে বৃষ্টি হলে সব পণ্ড! সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে বিকল্প প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে শুধু পাঁচশো বসার আসন রয়েছে। আশপাশে দাঁড়াতে পারেন আর জনা তিনশো।”
শপথ ছ’টায় হলেও দুপুর তিনটে থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করবেন। তিন ঘণ্টার একঘেঁয়েমি কাটাতে থাকছে গান-বাজনাওন। বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান বাজানোর জন্য থাকবে তিন সেনার ব্যান্ড। সরাসরি সম্প্রচার হবে দূরদর্শনে। গোটা শপথ অনুষ্ঠানটি রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরে দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বড় স্ক্রিন লাগিয়ে সম্প্রচার করা হবে। আর থাকবে রাষ্ট্রপতির ঘোড়া। তারা আজ সন্ধ্যায়ই মহড়া দিয়ে ফেলছে। সন্ধে নামতেই জ্বলে উঠবে এক হাজার বাতি। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের কাছে এ এক ইতিহাস।
মহাযজ্ঞের আয়োজনকে মসৃণ করতে দিল্লিকে পরিণত করা হচ্ছে এক নিরাপদ কেল্লায়। রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশেই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দফতর। দুপুর ১টার পর থেকেই সব অফিসে তালা ঝুলবে। কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে সবেতন ছুটি। আশপাশের ২ কিলোমিটার এলাকা চলে আসবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। এমনকী সংবাদমাধ্যমকেও যেতে হবে সরকারের দেওয়া নির্দিষ্ট গাড়িতে। ভিতরে কোনও মোবাইল ফোনের অনুমতি নেই। গোটা রাজধানীতে এখন থেকেই চালু হয়ে গিয়েছে ১৪৪ ধারা। ছ’হাজার নিরাপত্তা কর্মী ঘিরে রয়েছে গোটা এলাকা। সেনা ও আধা-সেনা মোতায়েন শুরু হয়ে গিয়েছে রাত থেকেই। তল্লাশি চলছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। জঙ্গি হামলা ঠেকাতে সড়ক ও আকাশপথেও থাকছে নজরদারি। উঁচু বাড়ির উপরে থাকছে স্নাইপার, এনএসজি-র সার্প স্যুটার। সতর্ক বায়ু সেনা। ডগ স্কোয়াড, ১৫ টি বম্ব স্কোয়াড চালাচ্ছে চিরুনি তল্লাশি।
প্রজাতন্ত্র দিবসে যেমন নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়, রবিবারের দিল্লি যেন তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy