Advertisement
E-Paper

ইস্তাহারে দু’গোল হজম করেও সঙ্ঘকে পাল্টা ছ’গোল মোদীর

অবশেষে লোকসভা ভোটের প্রথম দিনে প্রকাশিত হল বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার। আর তার পরেই প্রশ্ন উঠল, তা হলে জিতল কে? নরেন্দ্র মোদী? না নাগপুর? কারণ, সঙ্ঘ পরিবারের আর্শীবাদধন্য হয়েই বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর গদিতে বসা মোদীর সঙ্গে সঙ্ঘের লড়াইয়ের পূর্বাভাস রয়েছে আজকের নির্বাচনী ইস্তাহারে। ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ মোদীর এই মূল স্লোগানকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে বিজেপির ইস্তাহার।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৫

অবশেষে লোকসভা ভোটের প্রথম দিনে প্রকাশিত হল বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার।

আর তার পরেই প্রশ্ন উঠল, তা হলে জিতল কে? নরেন্দ্র মোদী? না নাগপুর?

কারণ, সঙ্ঘ পরিবারের আর্শীবাদধন্য হয়েই বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর গদিতে বসা মোদীর সঙ্গে সঙ্ঘের লড়াইয়ের পূর্বাভাস রয়েছে আজকের নির্বাচনী ইস্তাহারে।

‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ মোদীর এই মূল স্লোগানকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে বিজেপির ইস্তাহার। মোদীর নিজের কথায়, “৪২ পৃষ্ঠার এই ইস্তাহারে পাখির চোখ একটাই অখণ্ড ভারত গড়ে তোলা। যে ভারত হবে এক শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র।” আর সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য রামমন্দির থেকে গো-হত্যা নিবারণের মতো গোঁড়া হিন্দু বিষয়গুলিকে তুলনায় কম গুরুত্ব দিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগোতে চাইছেন মোদী। চাইছেন বিদেশি লগ্নি এনে উন্নয়নের রথ চালাতে।

সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে মোদীর সংঘাতের পূর্বাভাস এখানেই। সঙ্ঘের নেতারা রামমন্দির, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা করতে চান না। তাঁরা মনে করেন, হিন্দুত্বের এই বিষয়গুলি অবজ্ঞা করলে ভোটে ধাক্কা খেতে হবে বিজেপি-কে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ২০০৪ ও ২০০৯ সালে।

সুতরাং ইস্তাহারে কতটা অর্থনীতি আর কতটা হিন্দুত্ব এই প্রশ্ন সামনে রেখেই এত দিন টানাপড়েন চলছিল বিজেপি-র অন্দরে। আরএসএস-এর কথায় মুরলীমনোহর জোশীর নেতৃত্বে ইস্তাহার কমিটি যে খসড়া তৈরি করেছিল, তা হাতে নিয়ে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেন মোদী। শেষ পর্যন্ত যে ইস্তাহার চূড়ান্ত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষেরই কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে জয় হয়েছে মোদীরই। অন্তত ছ’টি বিষয়ে গোল দিয়েছেন তিনি। গোল খেয়েছেন দু’টি ক্ষেত্রে। কিন্তু রাজনীতির এই ফুটবল বুঝিয়ে দিল, প্রাক্-ভোট সমীক্ষা সত্যি প্রমাণ করে মোদী যদি ক্ষমতায় আসেন, তা হলে নাগপুরের সঙ্গে তাঁর সংঘাত তীব্র চেহারা নিতে পারে।

সঙ্ঘ-বিজেপি সংঘাতের ইতিহাস অবশ্য পুরনো। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক কে এস সুদর্শনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিষয়ে সরকারের তীব্র সংঘাত হয়েছিল। বিমা এবং ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ নিয়ে কুরুক্ষেত্র হয়েছিল অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা এবং স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের গুরুমূর্তি ও রাম মাধবের মধ্যে। সে দিন যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।

এ বারের সংঘাতে মোদী এবং সঙ্ঘ, দু’পক্ষই খানিকটা এগিয়েছে, খানিকটা পিছিয়েছে। এবং দুই শিবিরেরই দাবি, জয় তাদেরই হয়েছে।

সঙ্ঘের চাপে কোন কোন প্রসঙ্গ মানতে হয়েছে মোদীকে?

সবিস্তার...

প্রথমত, রামমন্দির। মোদী শিবিরের নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ ক’দিন আগেই বলেছিলেন, “এ বারের নির্বাচনে রামমন্দির প্রাসঙ্গিক নয়।” মোদী তো ইস্তাহারে রামমন্দির শব্দটিই রাখার পক্ষে ছিলেন না। পাছে ওই একটা শব্দ ঘিরে তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে মেরুকরণের অভিযোগ তোলা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গিলতে হয়েছে তাঁকে। তবে গত বারের ইস্তাহারে যে ভাবে রামমন্দির সম্পর্কে সুস্পষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছিল, এ বার তেমন নেই। ইস্তাহারের শেষ পৃষ্ঠায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার অনুচ্ছেদে রাখা হয়েছে রামমন্দির প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে, সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের সম্ভাবনার সব দিক খতিয়ে দেখা হবে।

এ প্রসঙ্গে মোদীর অন্যতম সেনাপতি অরুণ জেটলির ব্যাখ্যা, “আমার অভিজ্ঞতা হল উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দিলে মানুষ ততটা হাততালি দেয় না। কিন্তু যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি ওঠে তখন কর্মীদের উৎসাহ দেখার মতো।” বিজেপি-র আর এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য “রামমন্দিরটা অনেকটা কমিউনিস্টদের ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ স্লোগানের মতো। ওটা প্রথাগত ভাবে বলতে হয়। আমরা এ বারও এই সব কথা নমো নমো করে রেখেছি।” শুধু রামমন্দির নয়, রাম সেতু, গঙ্গা, গো-হত্যা রোধের মতো বিষয়গুলিও ইস্তাহারে নিয়মরক্ষার মতো করে উল্লেখিত হয়েছে।

মোদী দ্বিতীয় গোল খেয়েছেন বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে। এই ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে সঙ্ঘের ঘোর আপত্তি। মোদী কিন্তু এই প্রস্তাবের পক্ষে। ক’দিন আগে দিল্লিতে খুচরো ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে এসে তিনি তাঁদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হওয়ার বার্তাও দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, প্রতিযোগিতা এড়িয়ে বেশি দিন থাকা যাবে না। ইস্তাহারে এ প্রসঙ্গে দলীয় অবস্থান বদলের ঘোষণাটা হয়তো বাড়াবাড়ি রকমের চাওয়া হয়ে যেত। কিন্তু মোদী চেয়েছিলেন, অন্ততপক্ষে বিষয়টি যেন এড়িয়ে যাওয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে সরকার এই দরজাটা খোলার একটা সুযোগ পায়। কৌশলী মোদীর যুক্তি ছিল, “ইস্তাহারে তো কী কী করব, তা বলা হয়। কীসের বিরোধিতা করব, সে কথা বলার কী দরকার।” কিন্তু অনড় সঙ্ঘ তাঁর যুক্তি মানেনি।

সঙ্ঘের কাছে এই দুই গোল খেলেও পাল্টা অন্তত ছ’গোল দিয়েছেন মোদী। যেমন, কট্টর নেতাদের আপত্তি উড়িয়ে খুচরো ব্যবসা ছাড়া অন্য সব আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। ইস্তাহারে বলা হয়েছে, ব্যাঙ্ক, পেনশনের মতো ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি টানার ব্যাপারে সায় দেবে বিজেপি। যে অঙ্গীকার সঙ্ঘ নেতাদের কপালের ভাঁজ গভীর করতে বাধ্য।

এর পর রয়েছে সংবিধানের ৩৭০ ধারা। যেখানে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সঙ্ঘ পরিবার ঐতিহাসিক ভাবেই ওই মর্যাদা বাতিলের পক্ষপাতী। গত ইস্তাহারে জম্মু ও কাশ্মীর অধ্যায়ের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল, বিজেপি এই ধারা তুলতে দায়বদ্ধ। কারণ এটা কাশ্মীরবাসীর জাতীয় মূলস্রোতে মেশার পথে মনস্তাত্ত্বিক বাধা। সে অবস্থান সূক্ষ্ম ভাবে বদলে ইস্তাহারে মোদী বলেন, বিষয়টি নিয়ে দল সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলবে। যে ঘোষণাকে মোদীর তরফে সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে উঠে আসার প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। সে চেষ্টার অঙ্গ হিসেবেই সঙ্ঘ পরিবারকে বিস্মিত করে সংখ্যালঘুদের উন্নতির জন্য পৃথক অধ্যায় রয়েছে ইস্তাহারে। অতীতে সংখ্যালঘুদের জন্য এত সবিস্তার ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বিজেপি বলেনি।

সঙ্ঘ এবং জোশীর প্রিয় বিষয়, শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণকেও আমল দেননি মোদী। বাজপেয়ী জমানায় জোশী এই কাজটি করে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। আবার পাকিস্তান এবং চিন সম্পর্কে সঙ্ঘ যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিলেও মোদী ইস্তাহারে এই দু’টি দেশের নাম করেননি। যদিও অতিসক্রিয় কূটনীতির কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রয়োজনে শক্ত হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদের কোনও নিদর্শন ইস্তাহারে নেই।

একই ভাবে খোদ বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ চাইলেও পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা ইস্তাহারে নেই। মোদীর যুক্তি, এর ফলে অন্য রাজ্যগুলি ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ভোট বাজারে দলের সুবিধা হবে, এই যুক্তিতে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে কিছু আশ্বাসের দাবি দলে থাকলেও তা উপেক্ষা করেছেন মোদী।

এখন প্রশ্ন, সঙ্ঘের সঙ্গে মোদীর এই সংঘাত কতটা গুরুতর আকার নিতে পারে? বিজেপির অন্দরমহল বলছে, গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় কলঙ্কিত, সঙ্ঘের চোখে হিন্দুত্বের পোস্টার-বয় মোদী এখন অটলবিহারী বাজপেয়ী হয়ে উঠতে চাইছেন। লালকৃষ্ণ আডবাণীও একটা সময় বাজপেয়ীর মতো উদার হিন্দু মুুখ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান সফরে গিয়ে যার সূত্রপাত। কিন্তু দলের অনেক নেতার মতে, তিনি তাড়াহুড়ো করেছিলেন, যথেষ্ট হোম ওয়ার্ক করেননি। তাই বিপদে পড়েছিলেন।

মোদী তুলনায় অনেক বাস্তববাদী। তিনি জানেন, বিরোধী নেতা হিসেবে যা করা যায়, তার অনেক কিছুই ক্ষমতায় এলে করা যায় না। কিন্তু সেই পরিবর্তনের কাজটা করতে হয় ধীরে ধীরে। রইয়ে সইয়ে। সঙ্ঘের সঙ্গে সম্মুখসমরে গিয়ে তাঁর লাভ কিছু নেই। ঘনিষ্ঠ মহলে মোদী বলেছেন, “ইউ টার্ন করতে গেলে ধীরে ধীরে অনেকটা জায়গা নিয়ে গাড়ি ঘোরাতে হয়। বিশেষ করে যদি তার অনেকগুলি বগি থাকে। নইলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”

বিজেপি সূত্র বলছে, তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না বলেই মোদী মৌলবিদের হাতে টুপি পরতে রাজি হননি। অনেকে প্রস্তাব দিলেও গোধরা নিয়ে ক্ষমা চাইতেও রাজি হননি। বৈপ্লবিক রূপান্তর নয়, তিনি ধীরে সংস্কার করতে চাইছেন নিজেকে।

ফলে আডবাণীর মতো নেতাও আজ বলেছেন, “ইস্তাহারের খসড়া ওরা আমাকে দেখিয়েছিল। নরেন আমার সঙ্গে কথাও বলেছে। আমার মনে হয়, এই ইস্তাহারের মধ্যে একটা ভারসাম্য রয়েছে। বিজেপির কোর ইস্যুগুলিকে পরিত্যাগ করা হয়নি আবার উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।”

চিন্তাবিদ এ জি নুরানির মতে এটা বিজেপি-র দু’মুখো রণকৌশল। এক দিকে রামমন্দিরও থাকল। অন্য দিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রতত্ত্ব। অতীতে বিজেপির দুই মুখ ছিলেন বাজপেয়ী ও উমা ভারতী। এ বার হবেন মোহন ভাগবত ও নরেন্দ্র মোদী।

১৯৮৯-এ রামমন্দির আন্দোলনকে সামনে রেখে লোকসভায় বিজেপির আসন ২ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৮৬। ’৯১-তে ১২০। ’৯৬-তে ১৬১। ’৯৯-তে ১৮২। ছ’বছর ক্ষমতায় থাকার পরে ২০০৪-এ তাদের আসন কমে হয় ১৩৮। সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি, হিন্দুত্ব পরিত্যাগ ও প্রশাসনিকতায় জড়িয়ে পড়ার জেরেই পতন। এবং সে ভুল সংশোধন না করাতেই ২০০৯-এ তাই বিজেপি নেতাদের প্রতি মোহন ভাগবতের উপদেশ, ‘ব্যাক টু বেসিক’। ইস্তাহারে মোদী সেই উপদেশ মেনেছেন এবং মানেননি।

rss modi bjp manifesto
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy