ভূকম্পে আহত শিশু। ইম্ফলের হাসপাতালে বাপি রায়চৌধুরীর ছবি।
ঝাঁকুনি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু কেউ-ই ঘরে ঢুকছিলেন না। সবাই দাঁড়িয়ে বাড়ির গেটে বা রাস্তায়। শীতের কামড় ভুলেই প্রচুর মানুষ বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর ছেড়ে। হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটিতে রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙেছিল। মুহূর্তে তা-ও উধাও। এত লোক রাস্তায়, কারও মুখে টু শব্দ নেই। কাকে কী বলবেন, কেউ যেন কথাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
অন্য সময় উলুধ্বনিতে জানাজানি হতো, ভূমিকম্প হচ্ছে। আজ ভোরের ঝাঁকুনিতে সেই শব্দ শোনা যায়নি। বাজেনি আগের মতো কাঁসর-ঘণ্টা। প্রথম ঝটকাতেই টের পান হরিনগরের অর্পিতা পাল, রংপুরের হেমা রায়-রা। তাঁরা বললেন, ‘‘এই প্রথম ভূমিকম্পে উলুধ্বনি ভুলে গেলাম। মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ছেলেমেয়েদের নিয়ে কত দ্রুত ঘর থেকে বেরতে পারি।’’
অন্ধকারে দরজা হাতড়ে বেরনোর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে কিশোর কর্মকার, ইকবাল বাহার লস্কর, নরোত্তম বর্মনদের। মোবাইল আজকাল সবার হাতে কার্যত সেঁটে থাকে। ভূ-কাঁপুনিতে তা-ও সঙ্গে আনতে পারেননি তাঁরা। বাইরে বেরিয়েও বহু সময় কেটে যায় তাঁদের স্বাভাবিক হতে। পরে কথা সরতেই এক আওয়াজ— আফটার শকের আশঙ্কা রয়েছে। কতটা ভূমিকম্প হলে এমন কাঁপতে পারে, সে হিসেব মেলাতে পারছেন না কেউ। আফটার-শকের কথাই বা কখন আসতে পারে, তা জানাও কঠিন ব্যাপার। তবু প্রথম সে কথাই মাথায় আসে সবার।
বরাক উপত্যকায় এর আগে ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সোনাই নদীর উপর সেতু ভেঙে পড়েছিল। একটি স্কুল-সহ কিছু বাড়িঘর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রিখটারে কম্পনের তীব্রতা ছিল ৫.৬। উৎপত্তিস্থলে তা ছিল ৬ রিখটার। ‘‘তবে সে বারের ঝাঁকুনিতে পেটে যে মোচড় দিয়েছিল, তা কয়েক দিন টিঁকে ছিল’’— বলছিলেন অশীতিপর হরিবালা দেবনাথ। সে দিনের কথা স্পষ্ট মনে রয়েছে বছর বাহান্নের উৎপল দাসেরও। তবু আফটার শক বলে কিছু শোনেননি সেই সময়।
গুজরাতের ভূজের ভূমিকম্পের পর ওই শব্দটি বরাকবাসীরও মাথায় গেঁথে গিয়েছে। তার উপর কয়েক দিন আগে নেপালে পর পর কম্পনের টিভি-দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। তাই ভূমিকম্প যতটা ভাবিয়েছে, আফটার-শকের আশঙ্কা ভুগিয়েছে তার চেয়ে বেশি। শীতের ভোর, পরনে রাত-পোশাক— তা নিয়েই খোলা আকাশের নীচে কেটে যায় অনেক সময়। পরে যখন যে যাঁর ঘরে ঢোকেন, তখনও যেন দুলুনি কমে না। একেই অনেকে আফটার-শক ভেবে হইচই বাঁধিয়েছেন। সন্ধ্যায়ও দুর্যোগ মোকাবিলা শাখায় ফোন গিয়েছে— ‘এখনও কি আর আফটার-শকের আশঙ্কা রয়েছে?’
ঘরের কলিং বেল তো দূর, কানের গোড়ায় অ্যালার্ম বাজলেও টের পায় না দশম শ্রেণির ছাত্রী ঝর্ণা। আজ ভোরের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যায় তারও। এটিই ভূমিকম্পের তীব্রতা বোঝার বড় মাপকাঠি মালুগ্রামের বৈদ্যবাড়ির। তারাপুরের ব্যবসায়ী শম্ভু মোদক বললেন, ‘‘ঘর থেকে বেরনোর সময়েই লোডশেডিং। বুঝতে বাকি নেই, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিদ্যুৎ দফতরই লাইন কেটে দিয়েছে। কিন্তু কী করি! মোবাইল ফোন সঙ্গে নিতে পারিনি। আবার গিয়ে মোবাইল খুঁজে নেব, সেই সময় কোথায়! হাতড়ে দরজার ছিটকিনি খুলি। শেষে ঘরে ঢুকে মনে হল, হাতের কাছেই ছিল ইনভার্টারের সুইচ। তা আর খেয়াল হয়নি।’’
শম্ভুবাবুর কথাই এ দিন বারবার শোনা গিয়েছে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে। চশমা ফেলে বাইরে এসে অশীতিপর হরিবালা চক্রবর্তী ভেবে অবাক— ঘুটঘুটে অন্ধকারে কী করে অন্যদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আবার এনআইটি-র ছাত্র অভিষেক ভট্টাচার্য বুঝে পাচ্ছেন না, রাতবিরেতে সিঁড়ি ভাঙেন যে ছাত্রাবাসে, সেই সিড়িতে কী করে হোঁচট খেয়ে পড়ে আক্ষরিক অর্থেই এখন শয্যাশায়ী!
কাছাড়ের জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন জানিয়েছেন, অভিষেকের মতো অল্পবিস্তর জখম হয়েছেন অন্তত ৪০ জন। বেশ কিছু সরকারি দালানবাড়িতে ফাটল ধরেছে। কয়েকটি বহুতল আবাসনেরও ক্ষতি হয়েছে।
এসএমএস, হোয়াটস অ্যাপে সবাই বলছেন— ‘অল্পেতে রক্ষা। সর্বশক্তিমান বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy