Advertisement
০৮ মে ২০২৪

খয়রাতি তত্ত্বেই আস্থা অটুট রাহুলের

শিল্পমহল তো বটেই ইউপিএ-র খয়রাতির অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের একাংশও সমালোচনায় মুখর। তুলনায় তাঁরা বাহবা দিচ্ছেন গুজরাতের ‘মোদী মডেলকে’। কিন্তু সেই তত্ত্ব খারিজ করে এ বারও কংগ্রেসের গরিব-দর্শন আঁকড়ে রইলেন সনিয়া-রাহুল।

ইস্তাহার প্রকাশ করছেন রাহুল গাঁধী। বুধবার। ছবি: রাজেশ কুমার।

ইস্তাহার প্রকাশ করছেন রাহুল গাঁধী। বুধবার। ছবি: রাজেশ কুমার।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

শিল্পমহল তো বটেই ইউপিএ-র খয়রাতির অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের একাংশও সমালোচনায় মুখর। তুলনায় তাঁরা বাহবা দিচ্ছেন গুজরাতের ‘মোদী মডেলকে’। কিন্তু সেই তত্ত্ব খারিজ করে এ বারও কংগ্রেসের গরিব-দর্শন আঁকড়ে রইলেন সনিয়া-রাহুল। আজ সভানেত্রীর প্রকাশ করা নির্বাচনী ইস্তাহারে স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং বয়স্কদের পেনশনের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করল কংগ্রেস।

২০০৪ সালে বিজেপি-র ভারত উদয়ের বিপরীতে আম আদমির কথা বলে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। তার পাঁচ বছর পরে তাদের হাতিয়ার ছিল একশো দিনের কাজ। আর এ বার খাদ্য সুরক্ষা। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের অঙ্গীকার গরিবের স্বার্থের সুরক্ষা। যদিও শিল্প মহলের কথা মাথায় রেখে ইস্তাহারে শিল্প ও পরিষেবা কর বিধি সরল করা থেকে শুরু করে শিল্প প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার কথা রয়েছে। কিন্তু রাহুল গাঁধীর কথায়, “কংগ্রেস অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পক্ষে। কিন্তু গরিবকে বাদ দিয়ে সেই বৃদ্ধি সম্ভব নয়। কংগ্রেস মনে করে গরিব ও পিছিয়ে পড়াদের ক্ষমতায়নের মধ্যেই আর্থিক বৃদ্ধির সূত্র নিহিত।”

মোদী-ম্যাজিক ঠেকাতে কংগ্রেস কেন তার গরিব-দর্শনে আস্থা রাখছে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরে যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তা মূলত শহুরে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরেও ৭০ কোটি মানুষের একটা বিরাট ভারত রয়েছে। কংগ্রেস এদের কথাও বলতে চায়।”

গরিবদের ক্ষমতায়নের স্লোগান গত দু’বারের মতো এ বারও বিজেপি-র আশায় জল ঢালবে বলে কংগ্রেস আশাবাদী। সেই কারণে তাবৎ জনমত সমীক্ষার ইঙ্গিত খারিজ করে সনিয়া বলেন, “জনমত সমীক্ষায় ভরসা নেই। অতীতেও তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ বারও হবে।” মায়ের পাশে বসা কংগ্রেসের নবীন কান্ডারি রাহুলের মন্তব্য, “এর আগে বিজেপি ভারত উদয় প্রচারের বেলুন ফুলিয়েছিল। কিন্তু সে বারের মতো এ বারও ভোটের পর সেই বেলুন চুপসে যাবে।”

কিন্তু সার্বিক বৃদ্ধির যে মডেলকে সামনে রেখে গত পাঁচ বছর সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস, তা অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশের সমর্থন কুড়োয়নি। তাঁদের মতে, আর্থিক বৃদ্ধির দিকেই সরকারের নজর দেওয়া উচিত ছিল। যেমনটা গুজরাতে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। সেই পথেই আর্থিক সমৃদ্ধি আসা সম্ভব। এই তত্ত্ব খারিজ করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দাবি করেন, “উন্নয়নের বিবিধ মডেল রয়েছে। যেমন গুজরাত মডেলও একটা উন্নয়ন মডেল। কিন্তু সার্বিক বৃদ্ধির যে মডেল ইউপিএ সরকার তথা কংগ্রেস গড়ে তুলেছে, সেটাই শ্রেষ্ঠ।” গত পাঁচ বছর ধরে বিজেপি-র ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাবও দিয়েছেন মনমোহন। বলেছেন, “বিজেপি ভেবেছিল আমি দুর্বল প্রধানমন্ত্রী। ভেবেছিল বোধহয় পালিয়ে যাব। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করেছি।

• তিন বছরের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধি ৮ শতাংশ।

• স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পেনশন, সামাজিক সুরক্ষার অধিকার।

• জেলা-পিছু পাঁচটি ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র।

• প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।

• আঠারো মাসে দেশের সব পঞ্চায়েতে ব্রডব্যান্ড।

• মহিলাদের স্বনিযুক্তিতে ন্যূনতম সুদে ১ লক্ষ টাকা ঋণ।

• নারী-হিংসা রুখতে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’।

• সাম্প্রদায়িক হিংসা দমন, দুর্নীতি দমন, ন্যূনতম মজুরি এবং

• তফসিলি জাতি ও উপজাতি কল্যাণ বিষয়ক একগুচ্ছ আইন।

• সংখ্যালঘুদের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ।

তবে বিদায়ী মনমোহন নয়, আজ কংগ্রেসের অনুষ্ঠানের সবটুকু জুড়ে ছিলেন ভবিষ্যতের নেতা রাহুল। অনুষ্ঠান মঞ্চের প্রেক্ষাপটের ছবিটিও ছিল সেই অর্থে প্রতীকী। চালচিত্রের এক কোণায় সনিয়া-মনমোহন। বাকি সবটায় রাহুল। যিনি ঘোষিত ভাবেই দলের ইস্তাহার রচনার প্রক্রিয়াকে এ বার নামিয়ে এনেছেন খোলা ময়দানে। দলের সরদ দফতর আকবর রোডে দরজা বন্ধ করে ভারী আলোচনার পরিবর্তে ইস্তাহার রচনার জন্য নিজেই বৈঠক করেছেন সমাজের নানা স্তরে। শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, শিল্পপতি, যুব সম্প্রদায়, হকার বাদ যাননি কেউ।

আর সেই আলোচনার নিরিখে সার্বিক উন্নয়নের কথাটাই নির্বাচনী ইস্তাহারে তুলে ধরতে চেয়েছেন রাহুল। কংগ্রেস সহ সভাপতির বক্তব্য, তাঁর লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট। সমাজের সত্তর কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার নীচ থেকে মধ্যবিত্ত স্তরে তুলে আনা। ইউপিএ সরকার ইতিমধ্যেই তাঁদের খাদ্য ও কর্মসংস্থানের আইনি অধিকার দিয়েছে। এ বার ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস তাঁদের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দিতে চায়। রাহুলের কথায়, “স্পষ্ট বলতে গেলে গরিবের পায়ের নীচে একটা ফরাশ পেতে দিতে চাইছি। যে ফরাশ হল, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের অধিকার। যাতে চিকিৎসার খরচ জোগাতে গরিব মানুষ আরও হতদরিদ্র হয়ে না পড়েন। যাতে তাঁদের মাথার ওপর ছাদ থাকে। পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও মেহনতি মানুষও যাতে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন।”

কংগ্রেসের এই প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভিজবে না বলেই মনে করছে বিজেপি। খোদ দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর কটাক্ষ, “কংগ্রেস গত দশ বছরে দেওয়া প্রতিশ্রুতিই পালন করতে পারেনি, তার ওপর নতুন গাজর দেখাচ্ছেন রাহুল।” যার জবাবে ইস্তাহারের অন্যতম রূপকার জয়রাম রমেশের মন্তব্য, “বিজেপি-র ক্ষোভটা বুঝতে পারছি। একশো দিনের প্রকল্পের জন্যই গত ভোটে তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। এ বারও সিঁদুরে মেঘ দেখছে।”

কিন্তু কংগ্রেসের ইস্তাহারের সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিকদেরও একাংশ। তাঁদের মতে, সামাজিক সুরক্ষার নামে গত দশ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খয়রাতি করেছে মনমোহন সরকার। তাতে মানুষের প্রকৃত ক্ষমতায়ন তো হয়ইনি, উল্টে আর্থিক ঘাটতি বেড়েছে। তার পরেও রাহুল একই পথে হাঁটলেন।

সমালোচনার জবাব দিয়ে জয়রাম বলেন, আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাদিক পদক্ষেপের কথা ইস্তাহেরে রয়েছে। আর্থিক সংস্কারের কতা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে উৎপাদন ক্ষেত্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। “তবে কংগ্রেসের দর্শন স্পষ্ট। সার্বিক উন্নয়ন ছাড়া আর্থিক বৃদ্ধি অর্থহীন।” মন্তব্য জয়রামের।

সমাজের সব স্তরে উন্নয়নের সুফল ছড়িয়ে দেওয়ার বার্তাই শেষ পর্যন্ত সব জনমত সমীক্ষার হিসেব উল্টে দেবে বলে আশাবাদী দল। সেই সঙ্গে মোদীর পক্ষে যে হাওয়া উঠেছে, তাকে স্তিমিত করে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের আস্থা ফেরানোও তাঁদের চ্যালেঞ্জ। তাই আজ জনমত সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন সনিয়া-রাহুল। রাহুল বলেন, “গত বারও বলা হয়েছিল, কংগ্রেসের খুব ধোলাই হবে। উত্তরপ্রদেশে তারা আটটির বেশি আসন পাবে না। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি যত দূর বুঝি এ বারও সেখানে চমক দেবে কংগ্রেস। জাতীয় স্তরেও ইউপিএ আগের মতোই ভাল ফল করবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

manifesto rahul gandhi congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE