Advertisement
০৫ মে ২০২৪

গাঁ-গঞ্জে বসছে মূর্তি, দলের ভরসা ‘তেলঙ্গানা তাল্লি’ সনিয়া

যেন ফ্ল্যাশব্যাকে চৌত্রিশ বছর আগের মেডক-কে দেখা! “রায়বরেলীর পাশাপাশি মেডক থেকেও লড়তে পারতেন সনিয়া গাঁধী! ক্ষতি কী হত?” কেন? আশপাশের চিৎকারে সত্যনারায়ণের পরের কথাগুলি আর শোনা গেল না! মেডকের গির্জাঘরকে ডান পাশে রেখে চলে গিয়েছে যে রাস্তা, সেই পথে ত্রিশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আন্দোল। শহর থেকে বড় জোর মিনিট চল্লিশের পথ। লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা।

অন্ধ্র ভাগের পর থেকে এ ভাবেই দেবীমূর্তি গড়ে সনিয়া গাঁধীকে পুজো করছেন তেলঙ্গানার বাসিন্দারা।—নিজস্ব চিত্র

অন্ধ্র ভাগের পর থেকে এ ভাবেই দেবীমূর্তি গড়ে সনিয়া গাঁধীকে পুজো করছেন তেলঙ্গানার বাসিন্দারা।—নিজস্ব চিত্র

শঙ্খদীপ দাস
মেডক (তেলঙ্গানা) শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৫
Share: Save:

যেন ফ্ল্যাশব্যাকে চৌত্রিশ বছর আগের মেডক-কে দেখা!

“রায়বরেলীর পাশাপাশি মেডক থেকেও লড়তে পারতেন সনিয়া গাঁধী! ক্ষতি কী হত?”

কেন? আশপাশের চিৎকারে সত্যনারায়ণের পরের কথাগুলি আর শোনা গেল না!

মেডকের গির্জাঘরকে ডান পাশে রেখে চলে গিয়েছে যে রাস্তা, সেই পথে ত্রিশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আন্দোল। শহর থেকে বড় জোর মিনিট চল্লিশের পথ। লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। জনস্রোত চলেছে আন্দোলের ফুটবল মাঠের দিকে। জনসভায় যেন আছড়ে পড়েছে মানব সুনামি। গাছের মগ ডালে চড়ে রয়েছেন মহিলারাও! তা-ও শাড়ি পরে! কপ্টার বিভ্রাটের কারণে হায়দরাবাদ থেকে গাড়িতে আসতে হচ্ছে সনিয়াকে। তাঁর পৌঁছে যাওয়ার সংবাদেই যেন বিস্ফোরণ হল! স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস এমনই যেন ওয়াংখেড়েতে নামতে চলেছেন সচিন তেন্ডুলকর! এবং প্রথম বলটাই সনিয়া খেললেন বাউন্ডারি হেঁকে! “আক্কালাকু, ছেল্লেল্লাকু, আন্নালাকু, তাম্মুল্লাকু না নমস্কারম! (আমার ভাই বোনেদের নমস্কার)”

পরের তিরিশ সেকেন্ড ধরে চিৎকার আর হাততালির শব্দ ডেসিবেলের হিসাবনিকেশ গুলিয়ে দিতে পারে। বাকি কুড়ি মিনিটে কী হল, সে ছবিটা এআইসিসি-র মিউজিয়ামে তোলা থাকবে নিশ্চয়ই! সপ্তাহ খানেক আগে এই মেডকেরই উত্তরে সনিয়াকে নিয়ে এমনই হিস্টিরিয়ার সাক্ষী থেকেছে করিমনগরও। তা হলে? অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসের সবটাই মাইনাস নয়, কিছু প্লাসও হচ্ছে?

তাই কি! তেলঙ্গানার মন পেতে এর পর সনিয়া কী বললেন, সে কথা আপাতত থাক। ফিরে আসা যাক, খাম্মাম, ওয়ারাঙ্গলে! “গত এক মাসে করিমনগর বা মেডকের সিকি আয়তনের কোনও সভা হয়েছে এখানে? সিকি ছেড়ে দিন, এক দশমাংশ!” ওয়ারাঙ্গল এন আই টি-র অদূরে কংগ্রেসের প্রচার দফতর। ভর দুপুরে ঢগ ঢগ করে প্রায় এক বোতল জল গলায় ঢেলে প্রশ্নটি ছুড়ে দিলেন, বিধানসভার প্রার্থী স্বর্ণ এরাবেল্লি। কেন হয়নি? “কংগ্রেসের নেতা কোথায়? তেলঙ্গানায় মুখ কে?”

এরাবেল্লির হতাশা কোনও বিক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া নয়! মহবুবনগরেও দেখেছি, রঙ্গারেড্ডির আসন ছেড়ে সেখানে লোকসভা ভোটে লড়ছেন কংগ্রেসের দুঁদে পোড় খাওয়া নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি! অথচ এই ‘প্যারাট্রুপারকে’ নিয়ে নিচুতলায় সন্তোষ নেই! তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি নেতা চন্দ্রশেখর রাও যখন হবু রাজ্য জুড়ে চরকিপাক খাচ্ছেন, বিপরীতে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী-পদ প্রার্থীর মুখটাই অমিল! তা হলে কাকে দেখে ভোট দেবেন মানুষ? এরাবেল্লি ভগ্নাংশ সেকেন্ড খরচ না করে, ইশারায় তাঁর বুকের ব্যাজটি দেখালেন। সনিয়ার ছবি। নীচে লেখা, জয় তেলঙ্গানা। ঠিক এক মাস পর ২ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে জন্ম নেবে দেশের ২৯তম রাজ্য তেলঙ্গানা। তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নব্য এ রাজ্যের দশ জেলায় ‘তেলঙ্গানা তাল্লি’ (তেলঙ্গানার মা) সনিয়াই ভরসা। নিজামাবাদ, মেডক, ওয়ারাঙ্গল, খাম্মাম, মহবুবনগরের গাঁ-গঞ্জের মোড়ে মোড়ে তাই কোথাও কোথাও সনিয়ার মূর্তি বসেছে গত দু’মাসে। যিনি ঝুঁকি নিয়ে তেলঙ্গানার জন্ম দিয়েছেন, সেই ‘ভগবান’ যদি বাঁচাতে পারেন!

আর সে জন্যই সনিয়ার ওপর যতটা শ্রদ্ধা সত্যনারায়ণ কিংবা এরাবেল্লির, অভিমানও যেন ততটাই গলা বেয়ে উঠছে! “আরও দু’দিন যদি প্রচারে আসতেন!”

অথচ পাঁচ বছর আগে কিন্তু ছবিটা এমন ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডি তখন কেরিয়ারের মধ্য গগনে। প্রার্থী বাছাইয়ে কংগ্রেসের দিল্লির মুরুব্বিদের মাথা গলাতে দেননি, এমনকী, সে বার কংগ্রেসের প্রচারে সনিয়াকে নিয়েও বিশেষ আগ্রহ দেখাননি রাজশেখর। পরিণামে ওয়ার্কিং কমিটির নেতারা এমন শাপ শাপান্ত শুরু করেছিলেন যেন অন্ধ্র থেকে একেবারে লোপাট হয়ে যাবে কংগ্রেস! শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তা হতে দেননি রাজশেখর! তামাম অন্ধ্রে লোকসভায় ৩২টি আসন জিতেছিল কংগ্রেস, বিধানসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেরিয়ে গিয়েছিল অনায়াসে। এমনকী পৃথক তেলঙ্গানা গঠনে জন্য চন্দ্রশেখরের লম্ফঝম্ফকে ধরাশায়ী করে এই তেলঙ্গানা থেকেও ১৭টি-র মধ্যে ১১টি আসন কংগ্রেসকে এনে দিয়েছিলেন রাজশেখর।

আর এখন, কপ্টার দুর্ঘটনায় রাজশেখরের মৃতুর পর অন্ধ্রে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে কংগ্রেসের কোনও নেতাকে, নিজের নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে যাঁর অন্তত কিছু প্রভাব রয়েছে। এমনকী পৃথক তেলঙ্গানা গঠন করে দিয়েও কোনও নেতাকে তুলে ধরতে পারেননি হাইকম্যান্ড।

হয়তো সনিয়া এটা বুঝেছেন বলেই এখানে দু’বার এসেছেন। রাহুল গাঁধীও এসেছেন দু’বার। সেই সঙ্গে এআইসিসির অন্য অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতাই চরকি পাক খেয়ে চলেছেন তেলঙ্গানার অলিতে গলিতে। আর কংগ্রেসের সকলেই অনবরত নিশানা করে চলেছেন, চন্দ্রশেখর রাওকে! সনিয়ার কথায়, উনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে! যার মুখের ভাষা এত খারাপ, তিনি তেলঙ্গানা রাজ্য গড়বেন কী ভাবে?

কিন্তু এতেও কি শেষ রক্ষা হবে? স্পষ্ট করে না বললেও, তেলঙ্গানা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভাপতি পোন্নাইয়া লক্ষ্মাইয়া যা বোঝালেন, তাতে মৃত রাজশেখরের জাগিরটাই তাঁদের পুঁজি। তেলঙ্গানায় বর্তমানে কংগ্রেসের ১১ জন সাংসদ ছাড়াও বিধায়ক রয়েছেন ৫২ জন। রাজশেখর এঁদেরই গড়ে পিঠে তুলেছিলেন। পৃথক তেলঙ্গানা গঠনের দাবিতে এরা গত আড়াই বছর ধরে কেউ সংসদে, কেউ বিধানসভায় তোলপাড় করেছেন। আইনসভা থেকে বারবার ইস্তফা দিয়েছেন। কেউ অনশন করেছেন, কেউ বা টানা এক বছর জুতো পরেননি, কেউ বা মানত করে দাড়ি রেখেছেন। “তেলঙ্গানার মানুষ কি তা ভুলে গিয়েছে!”

তেলঙ্গানার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এম রামকৃষ্ণের কথায়, “চন্দ্রশেখরের সংগঠন শুধু চার জেলায়- আদিলাবাদ, নিজামাবাদ, মেডক ও করিম নগরে। কিন্তু তেলঙ্গানার সব জেলাতেই কংগ্রেসের সংগঠন ও কর্মী রয়েছেন। আর এ বার অনুঘটক হিসাবে রয়েছেন সনিয়া।”

রামকৃষ্ণের ব্যাখ্যায় মেডকের সত্যনারায়ণের কথা মনে পড়ে গেল! ঠিকই তো বলছিলেন। এ তো সেই ফ্ল্যাশব্যাকেই ফিরে যাওয়া। আশি সালে এই মেডক থেকেই কাম ব্যাক হয়েছিল প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর। রায়বরেলীর পাশাপাশি সেবার মেডক থেকেও লড়েছিলেন তিনি, এবং জিতেছিলেন দুটি আসনেই। তার পর অন্ধ্রের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে রায়বরেলী ছেড়ে ধরে রেখেছিলেন মেডক।

তেলঙ্গানা গঠনের মতো ঝুঁকি যখন নিলেন সনিয়া, তখন শাশুড়ির পথেই তো হাঁটতে পারতেন! ক্ষতি কী হত?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

telengana sonia sankhadeep das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE