এ যাবৎ দীর্ঘতম সময় ধরে চলা লোকসভা ভোটের প্রচারের দামামা বাজা আজ শেষ হল।
অতঃপর?
ঘরে ফিরে বিজেপি নেতারা যখন কেউ কেউ অনায়াসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের তাল ঠুকছেন, ভোট পরবর্তী পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী, তখন কোনও রকমে সাহসী মুখ দেখিয়ে স্রেফ আশায় বেঁচে রয়েছে কংগ্রেস। সেই আশা নিজেদের ভোট সম্ভাবনা নিয়ে যত না, তার থেকেও বেশি অন্যদের দিয়ে। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, দলের আসন এ বার আগের বারের থেকে অনেকটাই হয়তো কমে যাবে, কিন্তু এনডিএ-ও গরিষ্ঠতার সংখ্যা থেকে বেশ দূরে থাকবে। এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ কোনও আঞ্চলিক শক্তি বিজেপি-র সরকার গড়তে এগিয়ে আসবে না। এ ব্যাপারে মূলত মুলায়ম সিংহ, মায়াবতী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন কংগ্রেস নেতারা। শুধু তাই নয়, ঘরোয়া ভাবে এই শক্তিগুলোর কাছে ইতিমধ্যেই বার্তা পাঠাতে শুরু করেছে কংগ্রেস।
এ ব্যাপারে কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি আজ বলেন, “গত কয়েক দিন ধরে নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপি নেতারা যে ভাবে নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ শুরু করেছেন, তাতেই বোঝা যাচ্ছে বেলুনের হাওয়া বেরোতে শুরু করেছে। ২৭২ আসন পাওয়া দূরস্থান, তার ধারে কাছেও পৌঁছবে না বিজেপি বা এনডিএ। তা ছাড়া কোনও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি তাঁদের স্পর্শ পর্যন্ত করবে না।” এমনকী কটাক্ষ করে অভিষেক এ-ও বলেন, “১৬ মে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে।” অন্য দিকে বিজেপি-র সম্ভাবনার কথা খারিজ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম আজ বলেন, সরকার গঠনের মতো সুযোগ এলে পিছিয়ে থাকবে না কংগ্রেস।
তবে নরেন্দ্র মোদীর রথ রুখে দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেস পরিবারে সবাই যে আত্মবিশ্বাস দেখাতে পারছেন, তা নয়। নির্বাচনের শুরু থেকেই অবশ্য তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের মধ্যে। কিন্তু আজ নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার পর ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলছেন, প্রাকভোট এনডিএ যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে দূরে থাকবে, তা বিজেপি-র শরীরের ভাষাতেও এখন স্পষ্ট। না হলে নরেন্দ্র মোদী মায়াবতী বা জয়ললিতার কথা বলতেন না। আবার রাজনাথ সিংহ-রাও বাংলার জন্য আর্থিক প্যাকেজের কথা তুলতেন না। কারণ, বিজেপি নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাঁদের আরও নতুন শরিক প্রয়োজন। এবং ছোট খাটো এক-দুটো আঞ্চলিক শক্তি দিয়ে হবে না। প্রয়োজন হতে পারে একাধিক বড় শক্তির।
বিজেপি সূত্রের খবর, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী নিশ্চিত, সরকার গড়তে আর কোনও নতুন শরিকের প্রয়োজন হবে না। তিনি নিশ্চিত দেশজুড়ে যে মোদী-হাওয়ার লহর বয়েছে, তাতে বিজেপি ও তার প্রাকভোট শরিকেরা সরকার গড়ার পক্ষে পর্যাপ্ত আসন সংগ্রহ করে নিতে পারবেন। মোদীর এই আত্মবিশ্বাস অবশ্য দলের সব নেতা (বিশেষত যাঁরা আডবাণী-অনুগত বলে পরিচিত) দেখাতে পারছেন না। তাঁদের কথায়, মোদী লহরে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে আশাতীত ফলাফলের হিসেব কষছেন নরেন্দ্রভাই। কিন্তু এই অঞ্চলে জাতপাত ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতেই ফি-বার ভোট হয়ে থাকে। এ বারও সেই ঐতিহ্য অটুট থাকলে বিজেপি কিন্তু হিসেব-মতো আসন সেখানে না-ও পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার গড়তে নতুন শরিক না-হলেই নয়। সে বিষয়টি মোদীও বিলক্ষণ বোঝেন, আর সে জন্যই সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে সম্ভাব্য শরিকদের উদ্দেশে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। কিন্তু শরিকেরা কি তাঁর পাশে আসবেন?
কংগ্রেস নেতাদের মতে, এমনিতেই জয়ললিতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক ভালো। ভোট প্রচারে একে অপরের সমালোচনা করলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী জয়ললিতা এনডিএ-কে সমর্থন দিতেই পারেন। জয়ললিতা যদি দেখেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রয়েছে, একমাত্র তখনই তিনি বিজেপি-র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তবে রাহুল শিবিরের আশা, মুলায়ম, মায়াবতী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও ভাবেই নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি-কে সরকার গড়তে সমর্থন করবেন না। এই কাজ করলে মুলায়মের সংখ্যালঘু ভোট বাক্সে ভাঙন ঠেকানো যাবে না। গত ভোটে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত কল্যাণ সিংহের দলের সঙ্গে জোট করে হাত পুড়িয়েছেন মুলায়ম। আবার মোদীর সঙ্গে হাত মেলালে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর নিজস্ব দলিত ভোট বিজেপি-র দিকে চলে যেতে পারে। অতীতে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক বার উত্তরপ্রদেশে সরকারও গড়েছিলেন মায়া। কিন্তু তার পর থেকে তিনি জোট গড়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। একই ভাবে সংখ্যালঘু ভোট হারানোর আশঙ্কা রয়েছে মমতারও। তা ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের একটা বড় অংশ কোনও ভাবে বিজেপি-র সঙ্গে আঁতাত চায় না।
এই অবস্থায় কলকাতায় ভোট প্রচারে গিয়ে রাহুল গাঁধী তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করলেও, মমতা সম্পর্কে কিছুটা নরম মনোভাব দেখিয়েছেন। ভবিষ্যতে মমতার সঙ্গে ‘পার্টনারশিপ’ গড়ে তোলার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। আবার মায়াবতী ও মুলায়ম সিংহের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছে কংগ্রেস। এমনকী দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, পরস্পর তালমিল করেই আজ বারাণসীতে রাহুল ও সপা নেতা অখিলেশ যাদব রোড শো করেছেন। এ ছাড়া ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক, তেলঙ্গানার নেতা চন্দ্রশেখর রাও এবং সীমান্ধ্রের নেতা জগন্মোহন রেড্ডির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রাকভোট জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসন শেষ পর্যন্ত যদি বিজেপির থেকে ১০০ কম থাকে, তা হলে কি সরকার গঠন থেকে তাদের রুখে দেওয়ার মতো নৈতিক অবস্থান থাকবে কংগ্রেসের?
জবাবে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি আজ বলেন, “১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর কংগ্রেসের আসন আগের থেকে কিছু কমতে পারে ঠিকই। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপি-র বর্তমান ১১৬ জন সাংসদের অনেকের বিরুদ্ধেই স্থানীয় স্তরে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা রয়েছে। ওই আসনগুলির সব কটায় যে বিজেপি জিতবে, তা-ও বলা যায় না!” সিঙ্ঘভির কথায়, খেলা এখনও বাকি বলেই এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মোদী-বাহিনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy