টেবিলের ওপর থরে থরে রাখা খান দশেক খবরের কাগজ। অর্ধেক তেলুগু, অর্ধেক ইংরেজি। ওরই মধ্যে থেকে একটি বেছে নিয়ে সোজা চলে গেলেন ভিতরের পাতায়। তেলুগু বুঝি না, তবু ওঁর দৃষ্টি যে দিকে, কর্কট-বৃশ্চিকের আঁকিবুকি দেখে বোঝা গেল, ওটা আজকের রাশি ফল না হয়ে যায় না! ভাঁজ করে সেটা রেখে দিয়ে এ বার টেনে নিলেন আর একটি কাগজ। এটিও তেলুগু। এবং ফের একই ভাবে সোজা রাশিফলের পাতায়। তার পর আরও একটি!
পরনে সাদা পুরোহাতা শার্ট, সাদা প্যান্ট। কপালে সরু করে আঁকা লাল টিকা। রোগা শরীরে ওঁর নাকটাই আগে নজরে পড়ে! হ্যাঁ ইনিই কলভাকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাও। পিতৃদত্ত পুরো নামটার সঙ্গে অবশ্য ওঁর দল তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির সমর্থকদেরই বিশেষ যোগ নেই। শত্রু-মিত্র সকলের কাছেই তিনি কেসিআর! পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের সঙ্গে যে তিন অক্ষর প্রায় সমার্থক।
মুখে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে কেসিআর ঢুকেছিলেন। অথচ একের পর এক কাগজের পাতা ওল্টাতেই মুখের ছবিটা কেমন বদলে গেল! ভীষণ বিরক্ত। তার পর হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে সতীর্থ কেশব রাওকে ডেকে নিলেন পাশের ঘরে।
তবে কি দিনের রাশিফলই কেসিআরের মেজাজ খিঁচড়ে দিল! সময়টা উপযুক্ত নয়?
কাগজের প্রথম পাতাটা চন্দ্রশেখর দেখলেনই না। কী ছাপা হবে হয়তো আগাম জানতেন! তিন দিন বাদেই তেলঙ্গানায় ভোট। আনুষ্ঠানিক ভাবে সংসদে তেলঙ্গানা বিল পাশের পর এই প্রথম দু’দফায় নির্বাচন হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশে। তেলঙ্গানার ১৭টি লোকসভা ও ১১৯টি বিধানসভায় একই সঙ্গে ভোট হবে এপ্রিলের শেষ দিনে। সেই ভোট থেকে প্রাপ্তির আশা যাঁর সবচেয়ে বেশি, তাঁর বিরুদ্ধেই কিনা শুক্রবার তদন্তের নির্দেশ দিল হায়দরাবাদের বিশেষ সিবিআই আদালত। অভিযোগ, শিল্পপতিদের থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা তোলাবাজি করেছেন চন্দ্রশেখর ও তাঁর শ্যালক। এবং সেই খবরই আজ সব কাগজের প্রথম পাতায়। এক ঘর লোক। সিবিআই নিয়ে মুখে রা পর্যন্ত কাড়লেন না কেসিআর। বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখেও না। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে সটান উঠে পড়লেন গাড়িতে।
তবে কি চন্দ্রশেখর ভয় পাচ্ছেন?
বানজারা হিল থেকে হেলিপ্যাডের দিকে ছুটল গাড়ি। আজ প্রথম সভা নালগোন্ডায়, পরেরটি নারায়ণপেট, দুপুরে আলমপুর। বেঙ্গালুরু হাইওয়ে ধরে আলমপুর পৌঁছতে গাড়িতে লাগে প্রায় দু’ঘণ্টা। স্কুল-মাঠে থিক থিকে ভিড়। ঠা-ঠা রোদে কমবেশি সকলেরই হাতে জলের পাউচ, মাথায় গোলাপি টুপি। চারিদিকে গোলাপি শালুতে ছয়লাপ। কেসিআর পৌঁছলেন দেড়টায়। গোড়ায় দলের গান হল। তার পর কুড়ি মিনিটের বক্তৃতার শুরুতে কেসিআর নিজেই পেড়ে আনলেন সে কথা। “সিবিআই লেলিয়ে দিচ্ছিস, দে! ডিবিআই-ও লেলিয়ে দে! আরও কিছু আছে? তা-ও দে। তবু পারবি না।” বক্তৃতায় চন্দ্রশেখরের মুনশিয়ানা নিয়ে সুনাম রয়েছে। ভরাট গলার এমন শাসানি ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আলমপুরের মাঠে হাসির বোমা ফাটল। কেসিআর হাসলেন না। চোয়াল আরও শক্ত করে বললেন, “নিজেরা বড় বড় চোর, আবার আমার ওপর চৌকিদারি করে!” আলমপুরও এ বার আর হাসল না। শুধু গর্জে উঠল, ‘জয় তেলঙ্গানা’।
তবে কি চন্দ্রশেখর এ বার এতটাই বেপরোয়া?
হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। পৃথক তেলঙ্গানা আন্দোলনে নেমে একটানা এগারো দিন অনশনের পর এক সময় যায়-যায় অবস্থা হয়েছিল। তা-ও দমেননি। মেডকের যুব কংগ্রেস কর্মী থেকে যাত্রা শুরু করে সাত ঘাটের জল খেয়ে এ বার যখন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছে, তখনই কিনা সিবিআই! তদন্ত নিয়ে দিল্লির ওপর ঝাল ঝেড়ে তাঁর আন্দোলনের অতীতটাই আলমপুরে গেঁথে দিতে চাইলেন চন্দ্রশেখর। তুলে আনলেন তাঁর অনশনের কথা। ওসমানিয়া বিশ্ববিদল্যায়ের ছাত্রদের আত্মাহুতির কথা। আলমপুর তাতে উদ্বেল হল। মুঠো উঁচিয়ে আস্ফালন করল। মুঠো মুঠো গোলাপ পাপড়ি ছুঁড়ে দিল কেসিআর-এর যাওয়ার পথে!
তবে কি চন্দ্রশেখর এতটাই জনপ্রিয়?
আলমপুর পিছনে ফেলে চলে এসেছি মহবুবনগরে। রেভা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার বসন্তকে একটু খুঁচিয়ে দিতেই খাতা খুলে বসলেন। মহবুবনগরের বর্তমান সাংসদ চন্দ্রশেখর। তার আগে ছিলেন করিমনগরের। আর এ বার মহবুবনগরের পাট চুকিয়ে প্রার্থী হয়েছেন জন্মভিটে মেডকে। লোকসভা এবং বিধানসভা দু’টিতেই। কিন্তু মহবুবনগর ছাড়লেন কেন? প্রশ্ন শেষ না হতেই বসন্ত জবাব দিলেন, “এ বার দাঁড়ালে খাস্তা হতেন যে? ভোটে জেতার পর কস্মিন কালেও এখানে এসেছেন? উনি এরকমই। কথার কোনও দাম নেই।” বসন্ত এখানেও থামলেন না। বললেন, “তেলঙ্গানা বিল পাশের পর বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে এলেন। কিন্তু হায়দরাবাদে ফিরেই ফের গালমন্দ করেছেন সনিয়াকে। গোড়ায় বলেছিলেন, তেলঙ্গানা পৃথক রাজ্য হলে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী এক জন দলিত হবেন। এখন নিজেই মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইছেন। ক্ষমতার জন্য উনি সব পারেন।”
তবে কি শুধু নায়ক নন, চন্দ্রশেখর ভিলেনও?
বাস্তবে তেলুগু ছবির হিরোইন বিজয়শান্তি চন্দ্রশেখরের দলেই ছিলেন। চন্দ্রশেখর কথা রাখেননি ঠিকই, কিন্তু সংসদে পৃথক তেলঙ্গানা বিল পাশ হতেই বিজয়শান্তি কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছেন। টিআরএস ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার তালিকাটাও বেশ লম্বা। কেসিআর-এর তাতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে বটে। নিজে প্রার্থী হয়েছেন, মেয়ে কবিতা লোকসভা ভোটে লড়ছেন নিজামাবাদ থেকে, ছেলে তারক প্রার্থী হয়েছেন সিরসিলায়, সেই সঙ্গে শ্যালক হরিশ রাও-ও নেমে পড়েছেন ভোটে। তার পর তেলুগু দেশম, বিজেপি-র নেতা ভাঙিয়ে কয়েক দফায় প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছেন কেসিআর।
তবে কি কেসিআর এর দলে নেতাও কম পড়েছে?
কেসিআর আসার আগে বনজারা হিলের তেলঙ্গানা ভবনে বসে এই প্রশ্নটাই করেছিলাম কেশব রাও-কে। একদা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে থাকা কংগ্রেসের এই নেতাকে বছর খানেক আগে দলে এনেছেন কেসিআর। কেশব হেসে বলেছিলেন, “ধুর ধুর... কোথায় আছেন? তেলঙ্গানা এখন কেসিআর-এর। ওঁর মুখ দেখেই ভোট আসবে। প্রার্থী বড় কথা নয়।”
তাই কি! তা হলে ইস্তাহারে এতো আকাশ কুসুম প্রতিশ্রুতির বহর কেন রাখতে হয়েছে? কেজি থেকে পিজি অবৈতনিক পড়াশুনা, এক লক্ষ টাকার কৃষি ঋণ, তেলঙ্গানার সকলের জন্য উঠোন-সহ একতলা বাড়ি। হায়দরাবাদকে রাতারাতি সাংহাই করে তোলার আশ্বাস। তবে কি পৃথক রাজ্যের আবেগটাই শেষ কথা নয়? কেসিআর-ও শেষ কথা নয় তেলঙ্গানায়?
জবাব অবশ্য মিলবে। শুধু দিন কয়েকের অপেক্ষা।