ভাগ, ইউসুফ ভাগ। হুঁশিয়ারিটা প্রায় রোজ রাতেই অস্ফুটে কানে বাজে তাঁর। প্রাণ বাঁচাতে পালাতে থাকেন ইউসুফ। স্বপ্নের মধ্যেই ঘামে ভিজে যায় শরীর। এমনটা চলছে আজ এক যুগ ধরে।
ইউসুফের সঙ্গে দেখা গোধরা স্টেশনের বাইরে। ৪৪ ডিগ্রির ঝলসে দেওয়া রোদ্দুরে গাড়ি সারাইয়ের কাজে ব্যস্ত। গায়ের গেঞ্জিটা জবজবে ভিজে। এক মনে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাথমিক আলাপের পরে ২০০২ সালের প্রসঙ্গ তুলতেই দূরে ঠেলতে চান, “ছোড়িয়ে না সাব। পুরানি বাত। জিন্দা হ্যায় এহি কাফি।” ফের গাড়ির তলায় ঢুকে যান। পেটের দায়ে।
আরও অনেকের মতো ইউসুফও গোধরা সংঘর্ষের শিকার। ২০০২-এর ওই সংঘর্ষে সরকারি হিসেবে মারা গিয়েছিলেন অন্তত ৮০০ জন। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা ২০০০। বেঘর হন কয়েকশো মানুষ। ইউসুফ তাঁদের এক জন। পরিবারের চার জনকে হারিয়েছেন তিনি। কাদের অঙ্গুলিহেলনে ওই হিংসা সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি এখনও। এক যুগ পরেও তা নিয়ে অপরিচিত কারও সামনে খুলতে ইতস্তত করেন বছর ত্রিশের যুবক। যেন আজ আর স্মৃতি হাতড়ে কষ্ট পেতে চায় না গোধরার সংখ্যালঘু সমাজ। কিন্তু একটু ধৈর্য নিয়ে কথা বললে ব্যথার উৎসমুখ খুলতেও সময় নেন না সে দিনের দাঙ্গা পীড়িতেরা। বুঝিয়ে দেন, সে দিনের যন্ত্রণা আজও কতটাই তীব্র ভাবে তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁদের। ঘুমের ঘোরেও পালাতে থাকেন ইউসুফ।
ভারত শাসনের স্বপ্ন পূরণে গোধরাই যে তাঁর বড় পিছুটান, নরেন্দ্র মোদী তা বিলক্ষণ জানেন। তাই দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার আগে থেকেই সেই অপবাদ মুছতে তৎপর হয়েছিলেন তিনি। গোটা রাজ্যে শুরু করেন সদ্ভাবনা মিশন। রাজ্যের প্রায় সব ক’টি জেলা মিলিয়ে ৩৪টি সর্বধর্ম সমন্বয় সভা করেন তিনি। সরকারের ডাকে তাতে সামিল হন হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রিস্টান সব ধর্মের প্রতিনিধিরাই।
মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছে জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের মতো একাধিক সংখ্যালঘু সংগঠন। মোদী নিজেও তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চেষ্টার কোনও কসুর করছেন না। নিজের প্রচারসভায় এ যাবৎ হিন্দুত্ব নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি। সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন রাম মন্দির প্রসঙ্গও। এমনকী, সংখ্যালঘু সমাজ নিয়ে বিজেপি-র গিরিরাজ সিংহ বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়ার কড়া মন্তব্যের প্রকাশ্যে নিন্দাও করেছেন তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সমাজে চোরা বিদ্বেষ কি তাতে কমেছে? লাগাতার বার্তা দিয়েও কি মোদী নিজের রাজ্যের মুসলিম সমাজের সমর্থন টানতে পেরেছেন? রাজ্য বিজেপি নেতারা বলছেন, অবশ্যই। গুজরাতে মুসলিমদের একটি বড় অংশ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। দাউদি ভোহরা মুসলিমরা সংখ্যায় অল্প হলেও মোদীর পক্ষে। রাজ্য বিজেপি নেতাদের আরও দাবি, মোদীর গুজরাতে জাতপাত দেখে উন্নয়ন হয় না। উন্নয়নের সুফল পান সকলেই।
মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা তৌফিল আহমেদেরও বক্তব্য, মোদীর রাজত্বে উন্নয়নের সুফল পাচ্ছেন সব ধর্মের লোকেরাই। যদিও গোধরা টাউনের বাসিন্দা, পেশায় চিকিৎসক সুজাত বালি এই দাবি উড়িয়ে বললেন, “আমদাবাদের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জুহাপুরার সঙ্গে যে কোনও হিন্দু মহল্লার পরিকাঠামোগত ফারাকটাই বলে দেয়, সুষম উন্নয়ন হয়নি।”
কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমদাবাদের বুক চিরে যাওয়া সাবরমতীর দু’ধারের দৃশ্যপট সত্যিই ভিন্ন। প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, কেন এক দিকে সমৃদ্ধি অন্য দিকে অনুন্নয়নের এমন স্পষ্ট ছবি? প্রশ্ন রয়েছে আরও। সুজাতের কথায় “কেন আমদাবাদ-সহ রাজ্যের অধিকাংশ বড় শহরে হিন্দু মহল্লায় বাড়ি ভাড়া করতে বা কিনতে পারেন না কোনও মুসলিম? সে তিনি যতই শিক্ষিত হোক বা উচ্চবিত্ত হোন না কেন। গোধরার আগে মুসলিমরা নিজেদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব থাকলেও এখন তাঁরা নিজেদের রাজ্যের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। নিজের অধিকারের হয়ে কেউ আর মুখ খোলে না।” সুজাতের মতো শহরের আরও অনেকে মনে করেন, ক্রমশ ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে থাকতে ধর্মীয় নির্ভরতা বেড়েছে। রাজনীতিতে রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজের দুর্বল উপস্থিতিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন অনেকে। জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মুসলিম। কিন্তু গত ২৫ বছরে এ রাজ্য থেকে এক জন সংখ্যালঘুও লোকসভায় পা রাখেননি। ছবিটা এ বারেও বদলাবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে গোধরা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার প্রতি কদর বেড়েছে মুসলমান সমাজের। বিশেষ করে মহিলা শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষায় উল্লেখজনক ভাবে সংখ্যা বেড়েছে সংখ্যালঘুদের। রাজনীতির থেকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমাজের মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেই মনে করেন বডোদরার এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক জে এস বন্দুকওয়ালা। শিক্ষিত এই মানুষটিও ছাড় পাননি ২০০২-এর গোধরা- পরবর্তী সংঘর্ষে। বডোদরার কাছে সীমো এলাকায় পূর্বপুরুষের হাভেলি ধূলিসাৎ হওয়ার পর বডোদরার কাছে তিন কামরার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছেন।
এক রাতেই দুনিয়া পাল্টে যেতে দেখেছেন বন্দুকওয়ালা। ওই হিংসা-পর্বের আগে যাঁরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন, তাঁরাই পরে চিনতে পারতেন না তাঁকে। আগেও দাঙ্গা দেখেছেন এ রাজ্যের মানুষ। কিন্তু গোধরা-কাণ্ড কার্যত রাজ্যের মুসলিম সমাজকে মানসিক ভাবে নিঃস্ব করে দিয়েছে বলে মনে করেন বন্দুকওয়ালা। তাঁর মতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা ব্যাঙ্ক ঋণ সব কিছুতেই আজ দ্বিতীয় সারির নাগরিক হিসেবে গণ্য হন সংখ্যালঘুরা। বন্দুকওয়ালার দাবি, “সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও খুল্লমখুল্লা বৈষম্য। রাজ্যের ব্যাঙ্ক আমানতের ১২ শতাংশ আসে মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু গড়ে ঋণ পান মাত্র আড়াই শতাংশ মুসলিম। ফলে ছোট ব্যবসায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে সংখ্যালঘু সমাজ।”
আমদাবাদের হিন্দু ব্যবসায়ীদের অনেক আবার মনে করেন, গোধরার পরে দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ভাল হয়েছে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা আরও খোলা মনে ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছেন। বডোদরার চক্ষু বিশেষজ্ঞ অশোক মেটা যদিও বললেন, “ব্যবসা হয়তো বেড়েছে। কিন্তু কেবলমাত্র মুসলিম নাম নিয়ে ক’জন ব্যবসায়ী সরকারি ঠিকা পান, তা হাতে গুনে বলা যাবে। কোনও হিন্দু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদারি থাকলে তবেই মুসলিমরা ঠিকা পান। নচেৎ নয়।”
এমনিতেই আম আদমিকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা পানীয় জলের সুবিধা পৌঁছে দিতে অন্য অনেক রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে গুজরাত। আর মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই গরিব। ফলে পরিকাঠামোগত খামতির শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু সমাজ। রাজ্যের নিম্নমুখী মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকই তার প্রমাণ। অন্য দিকে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, মোদীকে ঠেকাতে এগুলি সব বিরোধীদের অপপ্রচার।
দাবি, পাল্টা দাবির মধ্যেই গোধরা স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে পরিত্যক্ত কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে সাবরমতী এক্সপ্রেসের আধপোড়া কামরাটা। প্রতিনিয়ত যা হয়তো জাগিয়ে রাখে ইউসুফদের স্মৃতির আগুনকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy