Advertisement
০২ মে ২০২৪

পাহাড়ের চূড়ায় সাজানো শহর

বিকেলবেলা এম জি রোড ধরে সোজা ম্যাল। ভারি চমৎকার পাথরে বাঁধানো জায়গাটি। এখানে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। দু’পা সম্বল করে মজাসে ঘুরে বেড়াও। ফুলের ঝাড়, সুদৃশ্য ল্যাম্পপোস্টের আলো, সাজানো দোকানপাট, সুবেশ, গৌরবর্ণ সুন্দর স্থানীয় তরুণ-তরুণীর এবং পর্যটকদের ভিড়ে স্থানটি যেন অন্য মাত্রা পেয়েছে। দোকানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের দিক থেকে হু হু করে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। মাঝে মাঝে ভিড় করে আসছে মেঘকুয়াশার দল। ঝিরিঝিরি নরম বৃষ্টি হয়ে তারা ঝরে পড়ছে আমাদের চোখে মুখে। পাহাড়ের ঢালে রাতের গ্যাংটক সেজেছে আলোর মালায়। সিকিম-ভ্রমণ কেমন বলছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।-রাজ, মাই ডার্লিং, আজ বহুদিন পর তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি পথের টানে। ওই তো দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশের ক্যানভাসে নীলচে ধূসর পাহাড়ের সানুদেশ। দু’পাশের শাল সেগুনের জঙ্গল চিরে এগিয়ে চলেছে পিচঢালা মসৃণ পথ। এই পথের প্রান্তে কী আছে রাজ, তার হদিস দেবে? রাজের চোখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি। পথের শেষ কোথায় সে তো জানা নেই। তবে চলতে চলতে একদিন নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে সে বিশ্বাস আছে।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

-রাজ, মাই ডার্লিং, আজ বহুদিন পর তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি পথের টানে। ওই তো দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশের ক্যানভাসে নীলচে ধূসর পাহাড়ের সানুদেশ। দু’পাশের শাল সেগুনের জঙ্গল চিরে এগিয়ে চলেছে পিচঢালা মসৃণ পথ। এই পথের প্রান্তে কী আছে রাজ, তার হদিস দেবে?

রাজের চোখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি। পথের শেষ কোথায় সে তো জানা নেই। তবে চলতে চলতে একদিন নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে সে বিশ্বাস আছে।

তোমাকে যাত্রাপথের সাথী পেয়েছি রাজ, গন্তব্য— তা সে যাই হোক যাত্রার আনন্দ, সে যে শতগুণ হয়ে ধরা দিল। তুমি আছ তাই আকাশ এমন নীল, গাছেরা এত সবুজ, মনের ভেতর যেন হাজার প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আমার ভীষণ ভাল লাগছে রাজ, ভীষণ ভাল লাগছে।

রাজের চোখে চোখ রাখলাম। সে চোখ আবেগে রক্তিম।

ততক্ষণে আমাদের জিপ তরাই ছাড়িয়ে হিমালয়ের পাকদণ্ডী পথ ধরে উঠতে শুরু করেছে। পথের সঙ্গী হয়েছে আরও একজন। তিস্তা। পাহাড়ি মেয়ের মতো উচ্ছ্বল এই নদীটিকে এখন দেখলে কে বলবে এই নদীই ভরা বর্ষায় হয়ে ওঠে ভয়ঙ্করী। কত দিন আগে পা রেখেছিলাম এই উত্তরবঙ্গে। প্রায় তিন দশক হতে চলল। তখন শৈশবের স্বপ্নমাখা চোখে দেখেছিলাম দার্জিলিংকে। আর এখন আবার সেই উত্তরবঙ্গের ওপর দিয়ে চলেছি। দেখার চোখ আজ কত বদলে গিয়েছে। অদ্ভুত এক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মন। আমার বাংলা এত বৈচিত্রময়। সমুদ্র, সমতল, মালভূমি, পাহাড়, জঙ্গল কি নেই এখানে। রাজ, তুমি কিছু বলছ না কেন?

রাজ হাসল। শুধু বাংলা কেন, আমাদের দেশ ভারত যে বৈচিত্রে পৃথিবীর সবার সেরা সে তো জানি। এই ভারতেরই কোণে কোণে লুকিয়ে রয়েছে কত সম্পন্ন, তার ঠিকানা পেতে হলে এক জন্ম নয়, কত কত জন্ম পেরিয়ে যাবে। আমার ছোট্ট খুকি, আজ তোমাকে যেখানে নিয়ে চলেছি, সেই হিমালয়ের গিরিকন্দর কি তুমি এই ক’দিনে দেখে উঠতে পারবে? তোমার সাধের উত্তরবঙ্গ পেরিয়ে সে পর্বতের ঠিকানা আরও দূরে। সে পর্বতশ্রেণি জুড়ে সরলবর্গীয় বৃক্ষরাজি, কত রকমের নাম না জানা রঙিন ফুল, পাখি, পর্বতের পাথুরে বুক বেয়ে নেমে আসছে সফেন ঝর্নার জল, ছোট ছোট পাহাড়ি নদী এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের আড়ালে আর আছে গুহাকন্দর, চিরতুষারে ঢাকা শৃঙ্গ। এ রাজ্যের আকাশ বাতাস ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদধন্য—মাটিতে প্রোথিত প্রার্থনা পতাকা আর বৌদ্ধ গুম্ফার প্রার্থনা চক্র মনের মধ্যে বয়ে আনে শান্তির ললিতবাণী। ‘ওঁ মণিপদ্মে হুং’ এই মন্ত্র যেন এই রাজ্যকে রক্ষা করে চলেছে কতকাল ধরে।

রাজ যাত্রার শুরুতেই তুমি মনটাকে উঁচু তারে বেঁধে দিলে। হিমালয়ের ধ্যানমগ্নতার নীরব দর্শক হতে চলেছি আমরা। কী অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে অথচ কী চরম উদাসীনতায় পর্বতরাজ ধ্যানগম্ভীর। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না কোনও কিছুই স্পর্শ করে না এই অভ্রভেদী হিমালয়কে! তবু কী দুর্নিবার এর আকর্ষণ। এক বার এর রূপ প্রত্যক্ষ করলে বার বার ছুটে আসতে হবে এর টানে।

সুধীজন, আপনারা নিশ্চয়ই আমাদের কথোপকথন থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছেন কোথায় চলেছি আমরা? হ্যাঁ, সিকিম। পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য সিকিম। ছোট্ট এক রাজ্য। তিন দিকেই বিদেশি রাষ্ট্র। উত্তরে তিব্বত, পর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল। কেবল দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের নিউজলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে জাতীয় সড়কপথে সিকিমে ঢুকতে হবে মেল্লি পেরিয়ে। দুই রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত এই ছোট জনপদ মেল্লি। এর পরেই আসে রংপো। শুরু হয়ে যায় পার্বত্য রাজ্য সিকিম। জাতীয় সড়ক ধরে সিংতাম, রানিপুল হয়ে গাড়ি পৌঁছে যায় রাজধানী গ্যাংটক। লিখতে যতটা সহজ, রাস্তা তত সহজ নয়।

সিকিমে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভালই বৃষ্টি হয় এবং এই সময় বৃষ্টি হলে রাস্তায় ধস নেমে অবস্থা তথৈবচ। তাই রাস্তার হাল মাঝে মধ্যেই বেশ খারাপ। রাস্তার অবস্থা ভাল নয় পশ্চিমবঙ্গের যে পার্বত্য অংশের ওপর দিয়ে এলাম সেই অংশেরও। তবু পথের সৌন্দর্য মন ভুলিয়ে দেয়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। রাস্তা ক্রমশ চড়াই হতে হতে পর্বতের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ধাবিত। নীচে গভীর খাদ। তারই মধ্যে চোখে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ধাপ কেটে চাষ, মাঝে মাঝে জঙ্গল, বাঁশঝাড় আর অজস্র ফুলের মেলা। কত রকমের রং সে সব ফুলের। হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, ম্যাজেন্টা, পার্পল, আকাশি নীল। আবার কোনও কোনও ফুলে দু’তিনটে রঙের বাহার।

দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাই একশো পঁচিশ কিলোমিটার পথ। অবশ্য গ্যাংটক শহরে প্রবেশের কিছু আগে ছেড়ে দিতে হয় পশ্চিমবঙ্গের জিপ। গ্যাংটকে ঢোকার পারমিট নেই এ গাড়ির। ট্যাক্সিতে পৌঁছে যাই আগেই বুক করে রাখা বাঙালি হোটেল ‘স্বর্ণচূড়া’য়। দার্জিলিং মেলে সকাল সাড়ে আটটায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গ্যাংটক পৌঁছতে প্রায় দুপুর। মধ্যাহ্ন আহারে বাঙালি খাবার— ভাত, ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল। ক্লান্ত শরীরটা খানিক বিছানায় এলিয়ে বিকেলবেলা এম জি রোড ধরে সোজা ম্যাল। ভারি চমৎকার পাথরে বাঁধানো জায়গাটি। এখানে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। দু’পা সম্বল করে মজাসে ঘুরে বেড়াও। ফুলের ঝাড়, সুদৃশ্য ল্যাম্পপোস্টের আলো, সাজানো দোকানপাট, সুবেশ, গৌরবর্ণ সুন্দর স্থানীয় তরুণ তরুণীর এবং পর্যটকদের ভিড়ে স্থানটি যেন অন্য মাত্রা পেয়েছে। দোকানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের দিক থেকে হু হু করে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। মাঝে মাঝে ভিড় করে আসছে মেঘকুয়াশার দল। ঝিরিঝিরি নরম বৃষ্টি হয়ে তারা ঝরে পড়ছে আমাদের চোখে মুখে। পাহাড়ের ঢালে রাতের গ্যাংটক সেজেছে আলোর মালায়।

গ্যাংটক শহরের অর্থ হল ভুটিয়া ভাষায় ‘পাহাড়চূড়ার ওপর অবস্থিত শহর’। এর গড় উচ্চতা পাঁচ হাজার পাঁচশো ফুট। লোকসংখ্যা পঞ্চাশ হাজার। তিব্বতের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের এক প্রধান কেন্দ্র গ্যাংটক সিকিমের রাজধানী হিসেবে গণ্য হয় ১৮৯৪ সালে। গ্যাংটকের আবহাওয়া গ্রীষ্মে বেশ আরামপ্রদ। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে এ সময় এর তাপমাত্রা আটাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত এবং বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় তাপমাত্রা নামতে পারে তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শীতে কিন্তু তাপমাত্রা সর্বোচ্চ আঠারো ডিগ্রি ও নর্বনিম্ন তিন ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। বছরে বৃষ্টিপাত হয় প্রায় দেড়শো ইঞ্চি।

গ্যাংটকেই রয়েছে পালজোর স্টেডিয়াম। সেখানো সিকিম গোল্ড কাপের আসর বসে। প্রায়ই হয় নানা রকম অনুষ্ঠান। শহরের মাঝে পালজোর সিকিমের গর্ব। সিকিম রাজ্যপালের বাংলোর সামনের রাস্তা থেকে রাতের পালজোর স্টেডিয়াম দেখা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। পাহাড় চুড়োয় খেলার মাঠ!

গ্যাংটকের পাশাপাশি সমগ্র সিকিম রাজ্যটিরই একটি ছোটখাটো বিবরণ দিয়ে নিই। ছোট্ট রাজ্য সিকিম, আয়তন মাত্রা সাত হাজার স্কোয়ার কিলোমিটারের একটু বেশি। মোট জনসংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। চারটি জেলায় বিভক্ত সিকিম। পূর্ব সিকিম যার সদর শহর গ্যাংটক, দক্ষিণ সিকিম—সদর শহর নামচি, পশ্চিম সিকিম—সদর শহর গেজিং এবং উত্তর সিকিম যার সদর শহর মাঙ্গান। সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দিক থেকে দেখতে গেলে এখানে রয়েছে উত্তর সিকিমে লেপচা, দক্ষিণে নেপালি এবং পশ্চিমে ভুটিয়া গ্রামগুলি। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সে তো অসাধারণ। পূর্ব সিকিমে সোগমো লেক, বাবা হরভজন সিংহ মন্দির এবং নাথুলা পাস আর উত্তর সিকিমে লাচুং, ইয়ুমথাং, লাচেন, গুরু দোংমার লেকের অসাধারণ তুষারবৃত রূপ দেখতে প্রতি বছর ভিড় জমান পর্যটকেরা।

পুরো সিকিম ভালভাবে ঘুরতে হলে হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের সময় কম তাই সিকিমের কিছু জায়গা বাদ পড়ে গিয়েছে। তবে এই কম সময়েও যা দেখেছি তা অনেক দিন মনের তৃষ্ণা মেটাবে।

গ্যাংটকের আশেপাশে পূর্ব সিকিমের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে দু’দিন কেটে গিয়েছিল। প্রথম দিন বাকথাং জলপ্রপাত, এনচে মনাস্ট্রি, তাশি ভিউ পয়েন্ট, গণেশ টক, হনুমান টক, ফ্লাওয়ার শো কমপ্লেক্স আর দ্বিতীয় দিন লিংডুম মনাস্ট্রি ও বনঝকরি জলপ্রপাত। সিকিমের প্রতিটি মনাস্ট্রিই অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা সমন্বিত স্থানে অবস্থিত এ কথা বলা বাহুল্য। তবে এর মধ্যে মনে দাগ কাটল লিংডুম মনাস্ট্রি। গ্যাংটক থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরত্বে পূর্ব সিকিমে এর অবস্থিতি। গুম্ফায় ঢুকবার পূর্বে অসংখ্য প্রার্থনা চক্র ঘুরিয়ে তবে প্রবেশ। বিশাল এর আয়তন। নির্জন হিমালয়ের কোলে অদ্ভুত এক পবিত্রতা বিরাজ করছে মনাস্ট্রি জুড়ে। বর্তমানে এখানে বৌদ্ধ তন্ত্র ও দর্শন চর্চা করা হয়। চোখে পড়ল খুদে সন্ন্যাসীদের যারা এখানে পড়াশোনা করে। লিংডুম যাওয়ার পথ অবশ্য মসৃণ নয়। রাস্তা বেশ খারাপ। তবে পথ চলতে গিয়ে দেখা মিলল অজস্র ফুলের যার মধ্যে গোলাপই বেশি। প্রতিটি বাড়ি সাজানো ফুলের টবে। খুব ছোট্ট বাড়িতেও সামর্থ্য মত ফুল গাছ রাখা। তবে ফুলের টবের বদলে অনেক ক্ষেত্রে কালো পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। পথেঘাটে নিতান্ত অবহেলায় যে গোলাপগুলো ফুটে আছে সেগুলোও রঙে ও আকৃতিতে অনবদ্য। সমতলে অনেক চেষ্টা করে যা ফোটাতে হয় তা এখানে আপনিই হয়ে আছে। আর চোখে পড়ল ছোট্ট ছেলে মেয়ে দল বেঁধে স্কুল চলেছে পাহাড়ি রাস্তায় খাদের ধার দিয়ে— বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও অভিভাবক ছাড়াই। ছোট থেকেই পাহাড়ের কঠিন জীবনের সঙ্গে এ ভাবেই তাদের পরিচয় ঘটে যায়। লিংডুম মনাস্ট্রি দেখে বনঝকরি জলপ্রপাতের কাছে ড্রাইভার ভাই গাড়ি থামালেন। এই জলপ্রপাতকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে নানা ধরনের মূর্তি, স্থাপত্য, সাঁকো ইত্যাদি দিয়ে। ঝরনার বন্য সৌন্দর্যকে বেঁধে ফেলা হয়েছে কৃত্রিমতার বেড়াজালে।

যেহেতু সিকিমের তিন দিকেই বিদেশি রাষ্ট্র, তাই এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্মি ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোদের তীক্ষ্ণ নজরদারি। গ্যাংটক থেকে নয় কিলোমিটার দূরে সাত হাজার দুশো ফুট উঁচুতে হনুমান টক ইন্ডিয়ান আর্মি কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এখানে হনুমানজির মন্দির রয়েছে। লোকের বিশ্বাস এখানে যা প্রার্থনা করা হয় তা পূরিত হয়। এই স্থানটির নির্জনতাও মনকে উচ্চমার্গে নিয়ে যায়।

গ্যাংটকের কাছে রয়েছে আর একটি মন্দির যেখানে পূজিত হন গণপতি— জায়গাটির নাম গণেশ টক। এই মন্দির থেকে দৃশ্যমান প্রকৃতিও ভারি সুন্দর।

গ্যাংটকে দু’দিন কাটিয়ে আমাদের গন্তব্য এ বার পশ্চিম সিকিমের পেলিং। তবে পেলিং যাওয়ার আগে আমরা ঘুরে যাব দক্ষিণ সিকিমের নামচির কাছে গড়ে ওঠা সিদ্ধেশ্বর ধাম বা চার ধাম। গ্যাংটক থেকে সিংতাম হয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথ ধরে নামচির দিকে। এই সময় পথে পড়ল সিকিমের একমাত্র চা বাগান টেমি টি গার্ডেন। এখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে পাহাড়ের ঢালে অপরূপ শোভা সবুজ চা গাছের। ১৯৬০ সালে চোগিয়াল পালডেন থণ্ডুপ নামগিয়াল এর প্রতিষ্ঠাতা। এখানকার অর্গানিক চা লিকার আর ফ্লেভার এর মিশ্রণে অনবদ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে এর কদর আছে।

গ্যাংটক থেকে নামচি প্রায় আটাত্তর কিলোমিটার। নামচি থেকে চারধামের দূরত্ব অল্পই। চার ধামে প্রবেশ করলেই দেখতে পাওয়া যাবে মহাদেবের বিশালাকায় মূর্তি। পাহাড়ের কোলে অপরূপ শিল্পসুষমায় গড়ে উঠেছে চারধামের মন্দির শ্রীক্ষেত্র বা পুরীর জগন্নাথ মন্দির, বদ্রিনাথ ধামের মন্দির, রামেশ্বর ও দ্বারকার অনুরূপ স্থপত্যে। একই স্থানে চারধাম দেখে অনেকেই মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারেন। এ ছাড়াও রয়েছে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অনুরূপ শিবলিঙ্গ। পাহাড়ঘেঁষা এমন সুরম্য স্থানে সিদ্ধেশ্বর ধামের অবস্থান পর্যটকদের মনে আধ্যাত্মিক ভাবের সঞ্চার করে। সিদ্ধেশ্বর ধাম দর্শন করে গ্যাংটকের হোটেলের বাঙালি পাচকের হাতে সযত্নে তৈরি পরোটা ও স্কোয়াশ-আলুর দম দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে এ বার যাত্রা শুরু রাবাংলার পথে। রাবাংলা হয়ে লেগশিপ, গেজিং পেরিয়ে পেলিং। একদিনে পূর্ব সিকিম থেকে দক্ষিণ সিকিম হয়ে পশ্চিম সিকিমে।

পাহাড়ি পথে চলতে চলতে কত অসাধারণ দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়েছি রাজের সঙ্গে। পাহাড়ের সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনই অভিভূত হয়েছি পাহাড়ি মানুষদের কষ্টসহিষ্ণুতা দেখে। পাহাড়ি নারী পুরুষ উভয়েরই অসীম ধৈর্য ও কর্মক্ষমতা। নীরবে হাসিমুখে কাজ করে যাচ্ছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার হাসিমুখে, পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ করে ফসল ফলাচ্ছে হাসিমুখে, ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে দল বেঁধে পাহাড়ি চড়াই পায়ে হেঁটে কত দূরে দূরে স্কুলে যাচ্ছে সেও হাসিমুখে। পাহাড়ের প্রকৃতির মতোই অনাবিল সরল তাদের সৌন্দর্য। কাউকে দেখলাম না হাত পাততে, প্রত্যেকে নিজের নিজের কাজটুকু সুষ্ঠ ভাবে সর্বদা করে চলেছে।

পাহাড়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে কখনও চোখে পড়ল নিবিড় বনানী। কখন মকাইয়ের ও এলাইচির ক্ষেত্র। কখনও তাজা ফুলকপি চাষ হয়েছে বা পেঁপে কিংবা কলা। এবং অবশ্যই স্কোয়াশ।

পেলিং পৌঁছতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। সকাল সাড়ে আটটায় গ্যাংটক থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পেলিং পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট জনপদ, মূলত পর্যটকদের আকর্ষণ করে কারণ এখান থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চ ও ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব ভাল ভাবে দেখা যায়। পেলিং এর হোটেল প্যারাজং-এ ভেজ মেমো সহকারে চা পান করে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি মেঘে ঢাকা চার দিক। হু হু করে পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। গ্যাংটকের থেকে পেলিং এর উচ্চতা বেশি, প্রায় সাত হাজার দুশো ফুট। তাই ঠান্ডাও এখানে একটু বেশি। তবে বেশ ভাল লাগছিল এই ঠান্ডা আমেজ। লোয়ার, মিডল ও আপার এই তিন ভাগে বিভক্ত পেলিং। আমরা ছিলাম মিডল পেলিং-এ।

পরদিনই বেরিয়ে পড়লাম পেলিং-এর আশপাশে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরে দেখতে। গাড়ি ঠিক করা ছিল। চালক নেপালি উনিশ বছরের ছটফটে ছেলে অর্জুন। গাড়ি চালাচ্ছে তিন বছর। প্রথমে একটি সরু কিন্তু বেশ দীর্ঘ জলপ্রপাত দেখিয়ে সে আমাদের নিয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত। রাস্তা থেকে এই প্রপাতের আসল রূপ চোখে পড়ে না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয় কিছুটা। এইখানে প্রপাতের ফেনিল জলরাশি প্রবল গর্জনে নীচে নেমে আসছে। পিচ্ছিল পথ। সাবধানে পায়ে পায়ে আবার নীচে নেমে আসি।

এর পরের গন্তব্য খেচুপেরি লেক বা খেচিওপালরি লেক। পেলিং থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগে গাড়িতে। পাথুরে রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে পথ চলা। গাড়ি যেখানে থামল সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটা পথ। পথের দু’ধারে নিবিড় গাছপালা। সূর্যের আলো ঢোকে না। ভিজে ভিজে স্যাঁতসেঁতে চার দিক। হ্রদের কাছাকাছি যেতে দেখি চারপাশে পাহাড়। হ্রদটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অসাধারণ তা নয়, এর ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। এর স্ফটিক জলের কাছে যা প্রার্থনা করা হয় তাই পূর্ণ হয় এমনই প্রচলিত বিশ্বাস। অজস্র প্রার্থনা পাতাকা প্রোথিত হ্রদের ধারে। হ্রদের পাশে রয়েছে একটি উপাসনাস্থল। অসংখ্য দীপ জ্বলছে সেখানে।

খেচুপেরি লেক দেখে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। তার পর আবার বেরোনো। এ বারের গন্তব্য পেমিয়াংসি মনাস্ট্রি। পেলিং থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ছয় হাজার আটশো চল্লিশ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই মনাস্ট্রির গৌরবগাথা অতি প্রাচীন। পেমিয়াংসি মনাস্ট্রির অর্থ ‘সর্বোত্তম পদ্ম’। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে নির্মিত এই মঠের ঐতিহ্য এখনও পুরোমাত্রায় রক্ষিত। আমরা যে দিন মঠে গেছি, সে দিন মঠে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। বিশাল দুখানি শিঙা বাজানো হচ্ছিল মঠের চাতালে। মঠের অভ্যন্তরে সন্ন্যাসীরা উপবিষ্ট। পূজা আরতি হচ্ছে করতাল বাজিয়ে। নৈবেদ্য রাখা হয়েছে ফল মূল সাজিয়ে। মঠের উপরের তিনটি তলা দর্শনার্থীদের জন্য খুলে রাখা হয়েছে। ছোটখাটো একটি মিউজিয়াম বললে ভুল হয় না। অসংখ্য বৌদ্ধ পুঁথি, মূর্তি, শিল্পকলার সমাহার সেখানে। এই মনাস্ট্রির প্রধান আকর্ষণ গুরু পদ্মসম্ভবের স্বর্গীয় বাসস্থান ‘জাংডোগ পালরি’-এর প্রতিরূপ। অপূর্ব বর্ণময় শিল্পসুষমায় ভরপুর এই নির্মাণটি কাষ্ঠনির্মিত। ১৯৭১ সালে এটি তৈরি করেছিলেন সেরদ্রুপ লন্দ্রুপ দর্জি রিংপোচে।

এই মনাস্ট্রির পর হেলিপ্যাড চত্বরে এক চক্কর মেরে আবার হোটেলে। এই হোটেলটিও বাঙালি হোটেল, কাজেই বাঙালি খানা মাছ ভাত বা মুরগির মাংস ঠিকই জুটে যাচ্ছিল। রান্নার হাতও বেশ ভাল। বেশ ঘরোয়া আতিথেয়তা।

অদ্য শেষ রজনী। পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে কী দেখব মনে হতে জানলার পর্দা সরালাম এবং আমাকে হতবাক করে দিয়ে আকাশের গায়ে ঝলসে উঠলেন কাঞ্জনজঙ্ঘা তার সঙ্গীসাথী শৃঙ্গ কুম্বকামা, কোকতাং, রাথোং, ফ্রে পিক, কাব্রু, গোয়েচা পিক, সিম্ভো, প্যান্ডিম এদের নিয়ে। এত দিন দেবতা দেখা দেননি। আজ শেষ দিন তাঁর দর্শন পেলাম। ধন্য হল এই তুচ্ছ জীবন।

বাকি রইল উত্তর সিকিম। রাজ, তুমি আবার আমাকে এখানে নিয়ে আসবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

paromita mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE