বিপদ ঠেকাতে রক্ষাকবচ আছে ঠিকই। কিন্তু তা ঠিকঠাক প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে মেটাল ডিটেক্টরকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়শই গলে যাচ্ছে বিপজ্জনক বিবিধ বস্তু। এবং আগাম আঁচ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও বানচাল করা যাচ্ছে না ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) দিয়ে জঙ্গি-নাশকতার ছক। খোদ সরকারের গোয়েন্দারাই এমনটা মনে করছেন।
তাই লোকসভা ভোটের প্রচারপর্বে ভিআইপি-দের নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি দেশ জুুড়ে পাঠানো এক সতর্ক-বার্তায় মন্ত্রক জানিয়েছে, জঙ্গি হানা প্রতিরোধে মেটাল ডিটেক্টর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ঠিকই। কিন্তু মেটাল ডিটেক্টর স্রেফ অনুষঙ্গ হয়েই থেকে যাবে, যতক্ষণ না প্রশিক্ষিত নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে। তা না-হওয়া পর্যন্ত আইইডি-হামলার সম্ভাবনা গোড়ায় নির্মূল করা মুশকিল হবে।
বস্তুত নিরাপত্তা-নজরদারির ঢিলেঢালা চেহারাটা দেশ জুড়েই প্রকট। কলকাতায় যেমন মেট্রো রেলের স্টেশন-সহ অনেক জায়গায় দেখা যায়, এক্স-রে ব্যাগেজ স্ক্যানারে যাত্রীরা জিনিসপত্র দিলেও রক্ষীরা মনিটরে ব্যাগের ভিতরের ছবি খুঁটিয়ে নজর করছেন না। আবার ভিআইপি-দের অনুষ্ঠানে ‘ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর’ বসানো থাকলেও হামেশা তা ঠিক মতো কাজ করে না। যন্ত্রটির মাধ্যমে তল্লাশি করতে হয় কী ভাবে, সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তাকর্মীদের অনেকেও সে সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন।
• ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টরের চার ধার ফাঁকা রাখতে হবে
• কাছাকাছি এসক্যালেটর-লিফ্ট ইত্যাদি থাকবে না
• এক এক করে প্রত্যেকে ভিতর দিয়ে যাবেন
• আগে কয়েন, চাবি, আংটি, গয়না ইত্যাদি সরিয়ে রাখবেন
• বিপদঘণ্টি বাজলে হাতে-ধরা যন্ত্র দিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা
• এ ক্ষেত্রে চাই যতটা সম্ভব উচ্চ ক্ষমতার মেটাল ডিটেক্টর
এ হেন গা-ছাড়া ও দায়সারা মানসিকতা থাকলে মেটাল ডিটেক্টরের ব্যবহারই অর্থহীন হয়ে পড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে ‘ন্যাশনাল বম্ব ডেটা সেন্টার’-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট। যাতে বলা হয়েছে, গত বছর বোমা বিস্ফোরণের সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে ভারতের স্থান তিন নম্বরে ইরাক, পাকিস্তানের পরেই। এমনকী, অশান্তিদীর্ণ আফগানিস্তানকেও টপকে গিয়েছে ভারত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩-য় আফগানিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে ১০৮টি। আর ভারতে ২১২টি। তাতে ১৩০ জন নিহত হয়েছেন, আহত ৪৬৬।
এমতাবস্থায় মেটাল ডিটেক্টরের মতো বিস্ফোরক সন্ধানী বৈদ্যুতিন যন্ত্রের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চায় কেন্দ্র। যে কারণে সেগুলো বসানো থেকে শুরু করে ব্যবহার কৌশলের নির্দিষ্ট পদ্ধতি বাতলেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)। কী রকম?
কেন্দ্রীয় আইবি’র পরামর্শ: আশপাশে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখে ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর বসানো দরকার। কেননা ধাতব বা বিপজ্জনক বস্তু বহনকারী লোকজন এক সঙ্গে তার কাছাকাছি এলে যন্ত্র ভুল সঙ্কেত দিতে পারে। আবার চলমান সিঁড়ি (এসক্যালেটর), লিফ্ট বা ঘুরন্ত দরজা (রিভলভিং ডোর)-র মতো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চলমান বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কাছাকাছি থাকলেও ডিটেক্টরের কার্যকারিতা বাধা পায়। এক-এক জন করে মানুষকে ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টরের তলা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেখতে হবে, আগে যেন প্রত্যেকে পকেট থেকে খুচরো পয়সা, চাবি, মোবাইল ইত্যাদি সরিয়ে রাখেন, খুলে রাখেন হাতের আংটি, কানের দুল বা গলার হারের মতো যাবতীয় অলঙ্কার। এর পরেও কারও ক্ষেত্রে বিপদঘণ্টি বাজলে তাঁকে হাতে-ধরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তন্নতন্ন করে তল্লাশি করতে হবে। তখন দরকার যতটা সম্ভব উচ্চ ক্ষমতার ডিটেক্টর, যা লুকিয়ে রাখা বিপজ্জনক বস্তুর অবস্থান দ্রুততার সঙ্গে চিহ্নিত করে দিতে পারে।
এ তো গেল গাফিলতির প্রসঙ্গ। একই সঙ্গে গত অক্টোবরে পটনায় বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর সভাস্থলের কাছে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ও তার আগে জুলাইয়ে বোধগয়ার ধারাবাহিক বিস্ফোরণের উদাহরণ দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে, নিরাপত্তায় ছিদ্র খুঁজে, প্রয়োজনে ছিদ্র তৈরি করে কী ভাবে নাশকতা ঘটানো যায়, সে ব্যাপারে সন্ত্রাসবাদীরাও ইদানীং সাংঘাতিক উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত, উল্লিখিত দু’টি ঘটনাতেই জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) জড়িত। আইবি-কর্তাদের এ-ও আশঙ্কা, গত অগস্টে আইএমের ‘অপারেশনাল চিফ’ ইয়াসিন ভটকলকে গ্রেফতারের বদলা নিতে মুজাহিদিনরা এখন মরিয়া। তাই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়ে তারা ভিআইপি-দের উপরে হামলা চালাতেই পারে। পাশাপাশি মাওবাদীরাও ভোটের সময়ে বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
কিন্তু যাঁদের জন্য নিরাপত্তার এত আয়োজন, এত নির্দেশিকা, সেই ভিআইপিরাই যদি তাকে গুরুত্ব না দেন, তা হলে কী হবে?
প্রশাসনিক মহলে এ প্রশ্নটাও দেখা দিয়েছে। বিশেষত রাহুল গাঁধী সম্প্রতি অসমে গিয়ে যে ভাবে সুরক্ষার ঘেরাটোপ ভেঙেছেন, তাতে পুলিশের কপালে ভাঁজ গভীর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনেক সময়ে নিরাপত্তার তোয়াক্কা না-করে ভিড়ে মিশে যান। তাতে এ রাজ্যের পুলিশও চিন্তিত। “ভোটের প্রচারকালে বহু নেতা-নেত্রীর মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়। ফলে আমাদের সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।” মন্তব্য করেছেন রাজ্য প্রশাসনের এক অফিসার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy