বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও ইঙ্গিত ছিল না। কিন্তু রাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিয়োগ কমিটির বৈঠকের পরে আচমকাই দেশের বিদেশসচিবের নাম বদলে যাওয়ার বিস্ময়ের ধাক্কাটা অনেকেই সামলে উঠতে পারেননি। কিন্তু গোটা ঘটনায় বেশ চটেছেন খোদ বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এতটাই যে, বৃহস্পতিবার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত দু’টি জনসভা আজ বাতিলই করে দেন তিনি। অস্বস্তির মুখে বিজেপি-র তরফে সরকারি ভাবে জানানো হয়, আসন্ন চিন সফরের আগে বিদেশ মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের থেকে ‘ব্রিফিং’ নেওয়ার জন্যই জনসভায় যাওয়ার মতো সময় বের করতে পারেননি সুষমা। যদিও বিজেপির এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ সরকারেরই একাধিক মহল।
সুষমা নিজে জনসভা বাতিলের কোনও নির্দিষ্ট কারণ না দেখালেও দিনভর বিতর্কের শেষে রাতে একটি টুইট করে এই নিয়ে জল্পনায় জল ঢালতে চেয়েছেন। বিদেশমন্ত্রী লিখেছেন, “আমি অতি অবশ্যই এই সিদ্ধান্তটির সঙ্গে যুক্ত। ব্যক্তিগত ভাবে সুজাতা সিংহের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জানিয়েওছি যে, সরকার এস জয়শঙ্করকে নিয়োগ করতে চাইছে।” রাজনৈতিক শিবিরের মতে, সুষমা চেয়েছিলেন সুজাতা সিংহই বিদেশসচিব হিসেবে থাকুন। কিন্তু যে ভাবে তাঁর মতকে উপেক্ষা করে তাঁরই মন্ত্রকের সবচেয়ে প্রবীণ আমলাকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা-ও আবার অবসরের সাত মাস আগেই, তাতে বেশ অখুশি সুষমা। মন্ত্রকের অনেকেরই বক্তব্য, বিদেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সুষমার সঙ্গে সুজাতার একটা ভাল কাজের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
গতকাল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটির সুজাতা-বিদায়ের নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আসরে নেমেছে বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, গত বছর মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সুজাতাকে নিয়ে এ পর্যন্ত তিন জন সরকারি শীর্ষ কর্তাকে আচমকাই সরিয়ে দেওয়া হল মোদীর ইঙ্গিতে। এর আগে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের প্রধান কে দুর্গাপ্রসাদ এবং ডিআরডিও-র ডিজি অবিনাশ চন্দ্রকেও এ ভাবেই সরানো হয়েছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা এ দিন বলেন, “যে ভাবে হঠাৎ করে বিদেশ মন্ত্রকের সবথেকে উচ্চপদস্থ মহিলা অফিসারকে সরানো হলো, তা মোদী সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করছে।” যার জবাবে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সুজাতাকে সরানোর থেকেও সরকারের বেশি তাগিদ ছিল জয়শঙ্করকে দ্রুত বিদেশ মন্ত্রকে নিয়ে আসার। কারণ আগামী ৩১ জানুয়ারি জয়শঙ্করের অবসর নেওয়ার কথা। তার আগেই এই সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে জয়শঙ্করকে বিদেশসচিব করে দু’বছরের জন্য রাখা সম্ভব হতো না। সেই কারণেই সুজাতার মেয়াদ ফুরনোর আগেই জয়শঙ্করকে এ ভাবে আনা হয়েছে। টুইটে এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন সুষমাও।
সুজাতার বিদায় নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠলেও সরকারের একটি শীর্ষ মহলের বক্তব্য, এ ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত কিন্তু ছিলই। মাত্র দিন কয়েক আগে রাষ্ট্রপতি ভবনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের আসরে সুজাতাকে দেখে অনেকেই বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। যেখানে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশেই হাজির প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে শুরু করে সরকারের প্রায় সব শীর্ষ নেতা-মন্ত্রী-আমলা, সেখানে সুজাতা যেন থেকেও ছিলেন না! এ নিয়ে একটা মৃদু গুঞ্জনও উঠেছিল সেই সন্ধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রের বক্তব্য, জয়শঙ্করের কাজে বহু দিন ধরেই খুশি প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চিন সফরে যান, তখন জয়শঙ্কর চিনে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিশেষত আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে জয়শঙ্করের ভূমিকা বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছে সাউথ ব্লকে। গত সেপ্টেম্বরে মোদীর ওয়াশিংটন সফর সফল করার জন্য বিস্তর খেটেছিলেন তিনি। প্রজাতন্ত্র দিবসে বারাক ওবামার সফর নিশ্চিত এবং ফলপ্রসূ করার পিছনেও জয়শঙ্করের বিশেষ ভূমিকা ছিল। পরমাণু, প্রতিরক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ঘুচিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে গত কয়েক মাসে। মোদী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে এর জন্য অনেকটাই কৃতিত্ব দিয়েছেন জয়শঙ্করকে।
তাঁর ঘনিষ্ঠ সুজাতাকে সরিয়ে জয়শঙ্করকে দায়িত্ব দেওয়ায় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে কী করবেন সুষমা? বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও তিনি যে বিদ্রোহী হবেন না, তা সুষমার এ দিনের টুইটেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অতীতে মোদী-বিরোধী হিসেবে সুর চড়ালেও বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সুষমার বিরোধিতার সুর নরম হয়ে গিয়েছে। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে আসল রাশ যে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতেই রেখেছেন, তা জেনেও চুপ থেকেছেন সুষমা। উল্টে ঘোষিত মোদী-বিরোধী আডবাণীর সঙ্গে যোগাযোগ সম্প্রতি অনেক কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। বন্ধ করে দিয়েছেন ফোন করাও। তবে রাজনাথ সিংহ এবং শিবরাজ সিংহ চৌহানের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সুষমার বার্তা স্পষ্ট আমি নিজের দায়িত্বে সন্তুষ্ট।
অন্য দিকে প্রকাশ্যে কোনও রকম অসন্তোষ জানাননি মেয়াদ ফুরোনোর আগেই সরে যেতে বাধ্য হওয়া সুজাতাও। বরং বলেছেন যে তিনিই নাকি দ্রুত অবসর চেয়েছিলেন। বিদেশ মন্ত্রকে সহকর্মীদের উদ্দেশে একটি বিদায়ী ই-মেল করে আজ এ কথা জানিয়েওছেন তিনি। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই ই-মেলে নতুন বিদেশসচিব সম্পর্কে কোনও অভিনন্দন বার্তা কিন্তু ছিল না!