Advertisement
০৮ মে ২০২৪

স্বাধীনতার যুদ্ধে বীর মারাঠা

পনেরোই অগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটা ছোটবেলা থেকেই মনে উদ্দীপনার সঞ্চার করে। কলকাতার বাগবাজারের রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। পনেরোই অগস্ট স্বাধীনতা দিবস স্কুলে সুচারুভাবে পালন করা হত। ক্লাস টেন অবধি প্রতিটি ক্লাসের প্রতিটি সেকশন থেকে স্বদেশ বিষয়ক দেওয়াল পত্রিকা বের করা হত। প্রত্যেকটি ক্লাসের মেয়েরা গাইত দেশাত্মবোধক গান।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

পনেরোই অগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটা ছোটবেলা থেকেই মনে উদ্দীপনার সঞ্চার করে। কলকাতার বাগবাজারের রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। পনেরোই অগস্ট স্বাধীনতা দিবস স্কুলে সুচারুভাবে পালন করা হত। ক্লাস টেন অবধি প্রতিটি ক্লাসের প্রতিটি সেকশন থেকে স্বদেশ বিষয়ক দেওয়াল পত্রিকা বের করা হত। প্রত্যেকটি ক্লাসের মেয়েরা গাইত দেশাত্মবোধক গান। স্কুলের ছাদে যখন ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলিত হত আমাদের বুক কি এক অজানা গর্বে ভরে উঠত। বুকের মধ্যে কাঁপন ধরাত - গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত ‘বন্দে মাতরম’ গান। একের পর এক গাওয়া হত ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হমারা’, ‘বিজয়ী বিশ্ব তিরঙ্গা প্যারা/ ঝান্ডা উঁচা রহে হমারা’ কিংবা ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমরে রঙ্গে’ এবং আরও কত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। মনের মধ্যে এক তীব্র দেশপ্রেমের বীজ বোধহয় তখন থেকেই রোপণ হয়েছিল। আর হবে নাই বা কেন - যে স্কুলে পড়তাম – সেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী সিস্টার নিবেদিতাও যে মনে প্রাণে চাইতেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। তিনি ছিলেন ‘বজ্রাদপি কঠোরানি, মৃদুনি কুসুমাদপি’ অর্থাৎ এক দিকে তিনি ছিলেন ফুলের মতো নরম, সুন্দর—স্নেহে, দরদে, সেবায় —অন্য দিকে বজ্রের চেয়েও কঠিন অসহিষ্ণু–অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সিস্টার নিবেদিতারও প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। নিজেকে অন্তরালে রেখে ভারতের যুব সম্প্রদায়কে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লববাদে সিস্টারের অবদান অনস্বীকার্য। সে কথা পরে কখনো আলোচনা করব।
গতকালই ঊনসত্তরতম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। যেখানে রয়েছি সেই মহারাষ্ট্রও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্মদানে ছিল রত্নগর্ভা। ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী তুমি মা, বীরপ্রসবিনী জননী, বাজুক নিত্য কালের চিত্তে তোমারই জয়ধ্বনি, জয় হিন্দ, জয় হিন্দ!’ আজ রোমন্থন করব কয়েক জন মারাঠাবীরের কাহিনি যাঁরা স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

প্রথমেই যাঁর কথা বলব তিনি হলেন ভারতের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের জনক বালগঙ্গাধর তিলক। এককথায় তাঁকে বিশেষিত করা দুঃসাধ্য। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় নেতা আবার অন্যদিকে ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃত, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও হিন্দুদর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। বালগঙ্গাধর তিলককে বলা হয় লোকমান্য তিলক। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই’। তিলকের এই উক্তি উদ্বুদ্ধ করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে।

১৮৫৬ সালের ২৩শে জুলাই মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে চিতপাবন ব্রাহ্মণ বংশে তিলকের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং গণিতে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি অন্যায় অবিচার একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। সত্যের প্রতি ছিলেন অবিচল। তিলক ছিলেন ভারতের যুবকদের মধ্যে প্রথম প্রজন্ম যাঁরা আধুনিক কলেজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তিলক গণিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক হন এবং তারপর আইন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন । তিলকের কর্মজীবন শুরু হয় গণিতের শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতার কাজ গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব তাঁকে পীড়া দিত এবং এ কারণেই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবল সমালোচনা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডেকান এডুকেশন সোসাইটি’ ভারতীয় যুবকদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য। এর পরের বছরই তিনি দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে শুরু করলেন – ‘কেশরী’ যেটি মারাঠি ভাষায় মুদ্রিত হত এবং ‘মারাঠা’ যার ভাষা ছিল ইংরেজী। তাঁর পত্রিকায় তিনি দেশের মানুষের প্রকৃত দুরবস্থার স্পষ্ট চিত্র এঁকেছিলেন। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি ঘুমন্ত ভারতবাসীদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দুটি পত্রিকাই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

বালগঙ্গাধর তিলকের রাজনৈতিক জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন ১৮৯০ সালে। এছাড়াও তিনি পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং বম্বে বিধানমণ্ডলের সদস্য ছিলেন এবং তিনি বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। সমাজসংস্কারমূলক কাজেও তাঁর মহৎ ভূমিকা ছিল। তিনি বাল্যবিবাহের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। গণপতি উৎসব এবং শিবাজীর জন্মোৎসব পালনের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলার বিপ্লব আন্দোলনে সরলা দেবী চৌধুরাণীর প্রবর্তিত শিবাজী উৎসব, দুর্গাপুজোয় বীরাষ্টমী উৎসব, লাঠি খেলা, অসি চালনা প্রভৃতি মারাঠাদেরই অবদান। কারণ, সরলা দেবীর মামা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বোম্বাই প্রদেশে জেলা জজ তখন তিনি তাঁর মামার কাছে গিয়েছিলেন এবং সম্ভবত ১৮৯২ সালে মারাঠাদের নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

যাই হোক, যা বলছিলাম – মারাঠা সিংহ তিলকের সম্বন্ধে। ১৮৯৭ সালে তিলকের বিরুদ্ধে বৃটিশ সরকার অভিযোগ আনে যে তিনি জনগণের মধ্যে বৃটিশ সরকারের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব জাগিয়ে তুলছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এবং আইন ও শান্তি ভঙ্গ করছেন। এই অভিযোগে তিনি জেলবন্দী হন দেড় বছরের জন্য। ১৮৯৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিলক স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। সংবাদপত্র এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তিলক মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে স্বদেশী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন এমনকি তাঁর বাড়ির সামনে স্বদেশী জিনিসের বাজারও খোলা হয়।

ভারতের জাতীয় রাজনীতিও এই সময় থেকেই অন্য দিকে বাঁক নেয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় – নরমপন্থী এবং চরমপন্থী এই দুই মতবাদে। এতদিন যেখানে নরমপন্থী নেতৃত্বগণ ইংরেজ সরকারের প্রতি আবেদন-নিবেদন নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, সেখানে চরমপন্থীদের দাবী হল স্ব-শাসন। বলা বাহুল্য, চরমপন্থীদের নেতৃত্ব দেন বাল গঙ্গাধর তিলক। ১৯০৬ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। ছয় বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর বার্মার মান্দালয় জেলে। এই দীর্ঘ সময় তিনি জেলের ভেতর লেখাপড়াতেই অতিবাহিত করেন। ‘গীতা-রহস্য’ তাঁর এই সময়ের রচিত গ্রন্থ। ১৯১৪ সালের ৮ই জুন তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। তিলক কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী মতবাদকে একত্রীভূত করতে চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা সফল হয় নি। অবশেষে তিনি একটি পৃথক সংগঠন স্থাপন করেন – ‘হোমরুল লীগ’। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ। বালগঙ্গাধর তিলক গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বরাজের অর্থ আপামর ভারতবাসীর মনে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক করতে চেয়েছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। ‘হোমরুল লীগ’ এর কার্যপদ্ধতি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সকলকে বুঝিয়ে তাদের হৃদয়ে স্বাধীন ভারতের চিত্র অঙ্কন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় ক্রমাগত ভ্রমণ করে গেছেন মানুষকে সংঘটিত করার জন্য। মানুষের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য বাল গঙ্গাধর তিলকের এই আত্মত্যাগ তাঁকে মহীয়ান করে তুলেছে। ১৯২০ সালে ১ অগস্ট মৃত্যু হয় মহাপ্রাণের।

মহারাষ্ট্রের আরো একটি পরিবারের কথা আপনাদের বলব, যে পরিবারের তিন ভাই ফাঁসির রজ্জু গলায় পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের বলি দিয়েছিলেন। সেই চাপেকার ভাইদের নাম ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে। দামোদর চাপেকার, বালকৃষ্ণ চাপেকার এবং বাসুদেব চাপেকার – এই তিন ভাই এরই ফাঁসি হয়েছিল বৃটিশ শাসকদের দ্বারা ১৮৯৮ এবং ১৮৯৯ সালে। দামোদর চাপেকার, বড় ভাই, জন্মগ্রহণ করেন পুণের চিঞ্চওয়াড়ে ১৮৬৯ সালে। দ্বিতীয় ভ্রাতা এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা বালকৃষ্ণ এবং বাসুদেব চাপেকার জন্মগ্রহণ করেন যথাক্রমে ১৮৭৩ ও ১৮৮০ সালে। সকলেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হন।

দামোদর চাপেকার সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন চিতপাবন ব্রাহ্মণ। মহারাষ্ট্রে চিতপাবন ব্রাহ্মণরা একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বৃটিশ সেনাবাহিনীতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হত না। সুতরাং দামোদর চাপেকারের সেনাবাহিনীতে যোগদানের আশা পূর্ণ হল না।

কিন্তু দমে না গিয়ে তিনি নিজেই তরুণদের নিয়ে একটি দল তৈরি করলেন এবং সেইসব যুবকদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুললেন। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বেলে বৃটীশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন।

১৮৯৭ সাল। মহারাষ্ট্রে প্লেগ মহামারীরূপে দেখা দিল। এক বৃটীশ অফিসার – পুণে শহরে মানুষের উপর নির্দয় ব্যবহারের জন্য যিনি কুখ্যাত ছিলেন – সেই অফিসার র‍্যাণ্ড প্লেগ কমিশনার নিযুক্ত হলেন। প্লেগ দমনে র‍্যাণ্ড অত্যন্ত অশোভন আচরণ শুরু করলেন। জোর করে শহর খালি করে দিতে লাগলেন এবং গোরা সৈন্যদের নিযুক্ত করা হল প্লেগ নিবারণের জন্য। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে যুবতী মেয়েদের গা টিপে দেখতে লাগল প্লেগ হয়েছে কি না। প্লেগ রোগ নির্ণয় করা এবং তার চিকিৎসা করা গোরা সৈন্যদের কাজ নয় এবং প্লেগ বেছে বেছে যুবতী মেয়েদের দেহেই বাসা বাঁধে না। গোরা সৈন্যদের বদ মতলব সম্বন্ধে মারাঠা মানুষদের মনে আর কোন সংশয় রইল না। এই ঘটনায় সমগ্র মারাঠা সমাজে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দিল ও মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। লোকমান্য তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘এর চেয়ে প্লেগ অনেক ভাল’। কিন্তু কিছুতেই বৃটীশ সরকার র‍্যাণ্ডকে অপসারিত করল না প্লেগ কমিশনারের পদ থেকে। অবশেষে দামোদর চাপেকার এবং তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সরিয়ে দিতে হবে এই ঘৃণ্য অফিসারটিকে। ১৮৯৭ সালের ২২শে জুন রাতে এল সুযোগ। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের ষাট বছর পূর্তির উৎসব শেষে র‍্যাণ্ড এবং আর এক অফিসার লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট যখন পুণে সরকারী ভবন থেকে ফিরছেন তখন একটি নির্জন স্থানে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দামোদর এবং তাঁর ভাই বালকৃষ্ণ চাপেকার গুলি করে হত্যা করে তাঁদের। লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। গুরুতর আহত অবস্থায় র‌্যান্ডকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন পর র‌্যান্ডের মৃত্যু হয়।

ভারতে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য স্যার রাউলাটের অধীনে একটি কমিশন গঠিত হয়। রাউলাট কমিটি এই হত্যাকে ভারতের প্রথম বৈপ্লবিক হত্যা বলে অভিহিত করে।

বিদেশী শাসকদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে যায়, কারা র‍্যাণ্ড ও আয়ার্স্টের হত্যাকারী! এত সাহস কার? শুরু হয় পুলিশি গোয়েন্দাগিরি। ধরা পড়েন দামোদর চাপেকার! তাও তাঁর এক সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতায়! গণেশ শংকর বিদ্যার্থী সব কিছু ফাঁস করে দেয় বৃটীশ সরকারের কাছে। দামোদরকে পুলিশ গ্রেফতার করে কিন্তু বালকৃষ্ণ অধরাই থেকে যান পুলিশের কাছে। দামোদরকে যখন কোর্টে বিচারের জন্য আনা হয়, তিনি বিচারকের সামনে মাথা উঁচু করে জবাব দেন যে, তিনি অত্যাচারী অফিসার র‌্যান্ডকে হত্যা করে কোন ভুল করেননি। এর জন্য তাঁর কোন অনুতাপ নেই। দেশের মানুষকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এই হত্যা।

বলা বাহুল্য, বিচারে দামোদর চাপেকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। জেলে থাকাকালীন বালগঙ্গাধর তিলক দামোদরকে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালের ১৮ই এপ্রিল পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে দামোদর চাপেকারের ফাঁসি হয়। সেই সময় তাঁর হাতে ছিল গীতা এবং তিনি আবৃত্তি করছিলেন গীতার শ্লোক।

ইতিমধ্যে, বালকৃষ্ণ চাপেকার এতদিন নিজাম রাজ্যের জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। তিনি মহারাষ্ট্রে ফেরার সময়ই পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। ভাই বাসুদেবও ধরা পড়লেন পুলিশের জালে। কিন্তু বাসুদেব পুলিশের সংগে একটা কৌশল করলেন। তিনি পুলিশকে বোঝালেন যে যদি তারা তাঁকে ছেড়ে দেন, তা হলে বালকৃষ্ণের অপরাধের পক্ষে তিনি প্রমাণ সংগ্রহ করবেন। পুলিশ বাসুদেবের জালে পা দিল। কারাগার থেকে মুক্ত করে দিল তাঁকে। আসলে বাসুদেব তাঁর দাদা দামোদরের ফাঁসির বদলা নিতে চেয়েছিলেন। দামোদরকে যে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই গণেশ শংকরকে ১৮৯৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বাসুদেব কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় গুলি করে হত্যা করে।

বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু!

ধরা পড়েন বাসুদেব। বালকৃষ্ণ, বাসুদেব এবং বাসুদেবের এক বন্ধু রানাড়ের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পুণেতে ১৮৯৯ সালের ৮ই মে বাসুদেব চাপেকার এবং ১২ ই মে বালকৃষ্ণ চাপেকারের ফাঁসি হয়।

সারা দেশে ঝড় বয়ে যায়। কারণ, একই পরিবারের তিন ভাইয়ের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করা বিরল ঘটনা। আর কি –ই বা বয়স তাদের! সদ্য যুবক!

স্বামী বিবেকানন্দ চাপেকার ভ্রাতাদের আত্মত্যাগের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাদের সোনার মূর্তি নির্মাণ করে বোম্বের জাহাজঘাটে স্থাপন করতে বলেছিলেন। সিস্টার নিবেদিতা ভারত ভ্রমণের সময় যখন পুণে শহরে যান, তিনি ভক্তিতে বিগলিত হয়ে চাপেকার জননীর সামনে দাঁড়ালেন। তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। ভারতের আর কোন মহিলাকে দেখে তিনি বিস্ময়ে এতটা অভিভূত হননি। এই মা ভারতবর্ষকে এমন সাহসী সন্তান উপহার দিয়েছেন! র‍্যাণ্ড ও আয়ার্স্ট হত্যা নিবেদিতা ভারতে আসার সাত মাস আগের ঘটনা।

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাব অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছিল। সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে কত মানুষ যে নিজেদের বলি দিয়েছেন তার খবর হয়তো ইতিহাসও রাখে নি। আমরা স্বাধীন ভারতের সন্তান যেন ভুলে না যাই তাঁদের কথা! শহীদের জীবন দান যেন ব্যর্থ না হয়। আমার দেশ, আমার ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক সবার সেরা। শেষ করি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কালজয়ী গানের কয়েকটি পংক্তি দিয়ে-

‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান

আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা,
দিবে কোন বলিদান?

আজি পরীক্ষা জাতির
অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুশিয়ার!’

ঋণস্বীকারঃ ১. হ্যাঙ্গড ফর দেয়ার প্যাট্রিয়টিজম:আর কে ট্যান্ডন ও ২. ভগিনী নিবেদিতা ও ভারতের বিপ্লববাদঃ শ্যামলেশ দাশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE