রাজশাহির গোদাগাড়িতে চর থেকে আসা নৌকা। —নিজস্ব চিত্র
বাচ্চু রাজাকার কোথায়?
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে গত বছর ২১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালত জামাতে ইসলামির প্রথম যে নেতাকে ফাঁসির সাজা দেয়, তিনি বাচ্চু রাজাকার। কিন্তু গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই দেশজোড়া সেনা-পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান এই রাজাকার শিরোমণি।
গোয়েন্দারা পরে জানতে পারেন, এই রাজশাহি-চাঁপাই করিডোর দিয়েই নেপাল হয়ে দিব্যি পাকিস্তানে পৌঁছে গিয়েছেন বাচ্চু রাজাকার।
রাজশাহি থেকে পদ্মা পেরোলেই লালগোলা, জেলা মুর্শিদাবাদ। আরও একটু এগিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উল্টো দিকে মালদহের ভগবানগোলা।
বিএসএফ-কে ফাঁকি দিয়ে সেখানে পৌঁছতে পারলে এক দিকে বিহার-উত্তরপ্রদেশ-দিল্লি-কাশ্মীর, অন্য দিকে নেপাল হয়ে পাকিস্তানের যে কোনও প্রান্তে অনায়াস যাতায়াত সম্ভব। এই কারণেই কি রাজশাহি-চাঁপাই করিডোরকে চোখের মণির মতো আগলে রাখে জঙ্গি-জামাত? অর্থ, অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান তো আছেই, হাই প্রোফাইল অপরাধীদের এই পথে বাংলাদেশের বাইরে বার করে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও সব সময়ে তৈরি রাখতে হয় জামাতকে।
অভিযোগ, অগোছাল সীমান্তের লাগোয়া এই এলাকায় দখলদারি রাখতে বিস্তর রেস্তও ঢালতে হয় জামাতকে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ থেকে পুলিশ, সীমান্তরক্ষী থেকে উকিল, এমনকী সাংবাদিকদের একাংশের কাছেও গোপনে টাকাকড়ি পৌঁছে যায় নিয়মিত। তার পরেও কেউ অতি উৎসাহী হয়ে জঙ্গিদের কাজ-কারবার নিয়ে তত্ত্ব-তালাশ করতে গেলে,
তাদের জন্য রয়েছে অন্য ওষুধ। দীর্ঘদিন জঙ্গিদের তাড়া করে বেড়ানো ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবীরের উপলব্ধি জঙ্গিরা কাউকে নিশানা বাছলে, তার পক্ষে প্রাণে বাঁচা অসম্ভব!
ওয়াকিফ হালেরা বলছেন ধর্ম নিয়ে কট্টরপন্থী রাজনীতি করলেও হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা-র মতো মাদক চোরাচালানে কোনও দিনই পিছিয়ে থাকেনি জামাত ও তার জঙ্গি সংগঠনগুলির ক্যাডারেরা। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মদ নিষিদ্ধ। আর সে জন্যই এ দেশের নেশাখোরদের কাছে আদতে কাশির ওষুধ ফেনসিডিল এবং ইয়াবা (রঙিন ট্যাবলেট, যা গলাঃধকরণে তুরীয় দশা প্রাপ্তি হয়) বেশ জনপ্রিয়। পাকিস্তান থেকে পাঠানো জাল নোট ভারতে পাঠাতেও সব চেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এই রাজশাহি-চাঁপাই করিডোর। আর বাংলাদেশে ঢোকে মুঙ্গেরি বন্দুক, একনলা, দোনলা। বারুদের বস্তা, গ্রেনেডের ফিউজ লাগানো সকেট বোমা।
জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয় নেতা আতাউর রহমানের অবশ্য দাবি, সব অপপ্রচার। জেএমবি-র সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। জামাতের কোনও নেতা-কর্মী চোরাচালানেও যুক্ত হন না। তবে সাধারণ মানুষ থেকে পুলিশ-প্রশাসন, সকলেই কিন্তু অন্য কথা বলেন।
রাজশাহিতে জামাত ও তার জঙ্গি-জালের নানা তথ্য অনায়াসে বলে চলেছিলেন সওকত শেখ। পুলিশের খাতায় তিনি ‘প্রাক্তন জেএমবি’ ক্যাডার। যদিও শহরিয়ার কবীর তা মানতে নারাজ। কবীরের দাবি প্রাক্তন জঙ্গি বলে কিছু হয় না। জেএমবি-র মতো সংগঠনগুলি যে নীতিমালা মেনে চলে, তার নাম মওদুদি নীতিমালা। মওলানা মওদুদি সাফ বলে গিয়েছেন জঙ্গি সংগঠন পাড়ার ক্লাব নয়, যে ইচ্ছে হল তো ছেড়ে চলে গেলাম। একমাত্র মৃত্যুই কর্মীদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে সংগঠন থেকে। কেউ সংগঠন ছাড়তে চাইলে তার মৃতদেহই মেলে। কবীরের স্পষ্ট কথা, “ভারতের জঙ্গি সংগঠন সিমি-ও এই নীতিমালাই মেনে চলে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমেদ হাসান ইমরান যে বলছেন, আগে সিমি-র নেতা থাকলেও পরে তিনি সে সংগঠন ছেড়ে দিয়েছেন এর চেয়ে বড় মিথ্যে আর হয় না। জঙ্গিদের দেওয়া অন্য কোনও দায়িত্ব পালন করছেন ইমরান।”
সওকত বলছিলেন মোদাচ্ছেরের কথা। চর আষাঢ়িয়াঘাটের এই বাসিন্দার দাবি, রাজাবাড়ি-সুলতানগঞ্জ এলাকায় অস্ত্র চোরাচালানের অনেকটাই তিনি সামলান। ভারত থেকে চোরাই মোবাইল আসে বাক্সে ভরে। সাদা বাক্স, কড়া সিল করা। বাক্স গুণে বখরা নিয়ে ছেড়ে দেয় সীমান্তের পাহারাদারেরা। সেই বাক্সের অনেকগুলোতেই মোবাইলের বদলে ভরা থাকে সকেট বোমা, বুলেট। এমনকী ছোট পিস্তলও। আবার হেরোইন বা অন্য মাদকও আসে এই মোবাইলের বাক্সে। বাক্সের ওপরে চিহ্ন দেখে আলাদা করে রাখা হয় মোকামে।
রাজশাহির নেতাদের বরাবরের রবরবা জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। সারা বাংলাদেশে মৌলবাদী জিগির তোলার ইন্ধন অনেকটাই যে সরবরাহ করে রাজশাহি জেলা শাখা! জঙ্গিদের নিয়মিত অর্থ সাহায্যের পাথুরে প্রমাণ হাতে পেয়ে রাজশাহি শহরের এক পরিচিত চিকিৎসককে গত বছর ৬ এপ্রিল গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ওই চিকিৎসক বেসরকারি ‘ইসলামি ব্যাঙ্ক মেডিক্যাল কলেজের’ যেমন ডিরেক্টর ছিলেন, জামাতে ইসলামির রাজশাহি শাখারও ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল। চার মাস জেলে থাকার পরে তিনি এখন জামিনে মুক্ত। কিন্তু পুলিশ জেনেছে, গত তিন বছরে তিনি বহু বার কলকাতা গিয়েছেন। উঠেছেন বন্দর এলাকায়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এক নেতার সঙ্গে তাঁর খুবই দহরম মহরম। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি জঙ্গিদের যে জাল উন্মোচিত হয়েছে, তাতে এই ডাক্তারের হাত থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। তাঁর সঙ্গে মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের যে যে নেতার যোগাযোগ ছিল, তার তালিকা ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছেও পাঠানো হচ্ছে।
সওকতের কথায়, রাজাবাড়ি-সুলতানগঞ্জ এলাকায় তো শুধুই ‘মাল’ খালাস হয়। মূল কারবারটা হয় রাজশাহি শহরে। খরিদ্দাররা সেখানে আসে, হোটেলে থাকে, বোঝাপড়া করে চলে যায়। মাল পৌঁছে যায় ঘরে। জোট শরিক বিএনপিকে নিয়ে রাজশাহি শহরের রাজনৈতিক দখল ধরে রাখতেও তাই মরিয়া জামাত। অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ওড়ে রাজশাহি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে। এ বারও সেখানে শরিক দলের প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে জামাত।
তবে ভয়ানক অভিযোগ করেছেন আওয়ামি লিগের পরাজিত প্রার্থী খায়েরুজ্জামান লিটন গত বছরের ওই নির্বাচনে সারদার কোটি কোটি টাকা ঢেলেছিল জামাত। সরকারকে চিঠি দিয়ে তদন্তও চেয়েছেন তিনি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy