Advertisement
০৬ মে ২০২৪

সনিয়া সরে দাঁড়ান রাহুলের বাধায়: নটবর

দশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। পরিবর্তে মনমোহন সিংহকে মনোনীত করে সনিয়া বলেছিলেন, ‘অন্তরাত্মার ডাকে’ এই সিদ্ধান্ত। অথচ আজ, এত দিন পর গাঁধী পরিবারের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ দাবি করলেন, “অন্তরাত্মার ডাক একেবারে বুজরুকি! আসলে রাহুল গাঁধীই চাননি তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী হোন। কারণ, রাহুলের ভয় ছিল, সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে রাজীবের মতো তাঁকেও মেরে ফেলা হবে!”

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

দশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। পরিবর্তে মনমোহন সিংহকে মনোনীত করে সনিয়া বলেছিলেন, ‘অন্তরাত্মার ডাকে’ এই সিদ্ধান্ত। অথচ আজ, এত দিন পর গাঁধী পরিবারের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ দাবি করলেন, “অন্তরাত্মার ডাক একেবারে বুজরুকি! আসলে রাহুল গাঁধীই চাননি তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী হোন। কারণ, রাহুলের ভয় ছিল, সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে রাজীবের মতো তাঁকেও মেরে ফেলা হবে!” নটবরের দাবি, শেষ পর্যন্ত ছেলের জেদের কাছেই হার মানেন সনিয়া।

‘ওয়ান লাইফ ইজ নট এনাফ’ নামে আত্মজীবনী লিখছেন নটবর। এক সপ্তাহ পর তা প্রকাশ হওয়ার কথা। তার আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ-ও দাবি করেন, বইয়ে যাতে এই সব বিতর্কিত বিষয় না লেখা হয়, সে জন্যই সনিয়া ও প্রিয়ঙ্কা বঢড়া তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সম্প্রতি। নটবরের দাবি, ভোলকার-কাণ্ডে মন্ত্রিসভা ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে তাঁকে বহিষ্কারের ঘটনা নিয়ে সে দিন দুঃখও প্রকাশ করেন সনিয়া।

প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রীর এই দাবি নিঃসন্দেহে আজ নতুন বিতর্কের জন্ম দিল। দশ জনপথকে তা অস্বস্তিতে ফেলল তো বটেই, প্রশ্ন তুলে দিল সনিয়ার সততা নিয়েও! কারণ, পর্যবেক্ষকদের মতে, সনিয়ার আত্মত্যাগই তাঁকে রাজনৈতিক উচ্চতা দিয়েছে। তা ছাড়া কংগ্রেসও গত এক দশক ধরে সেই স্বার্থত্যাগ নিয়ে কম বড়াই করেনি। কিন্তু এখন যদি দেখা যায়, তার মূলে ছিল ছেলের আশঙ্কা ও আপত্তি, তবে তা অস্বস্তির বৈকি!

প্রত্যাশিত ভাবেই নটবরের বক্তব্য খারিজ করতে চেয়েছে কংগ্রেস। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়ে হইচই শুরু হতেই দশ জনপথে আজ বৈঠকে বসেন কংগ্রেসের মুরুব্বিরা। তার পর দলের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেন বলেন, “এটা খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। বই বিক্রির জন্য ইদানীং উল্টোপাল্টা কথা লিখে চাঞ্চল্য তৈরি করা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাও সে রকমই একটা ঘটনা। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়াও অর্থহীন।” নটবরের দাবি খারিজ করে দিলেও সনিয়া ও প্রিয়ঙ্কা কেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তার উত্তর নেই কংগ্রেসের কাছে।

নটবরের অস্ত্র কিন্তু সেটাই। তাঁর কথায়, “বইটি নিয়ে কথা বলতেই এসেছিলেন সনিয়া-প্রিয়ঙ্কা। এটাই প্রমাণ করে আমি সত্যি বলছি।”

নেহরু-ইন্দিরা জমানা থেকেই গাঁধী পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিলেন প্রাক্তন কূটনীতিক নটবর সিংহ। সেই সখ্যের কারণেই বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ আমলার পদ থেকে অবসরের পর ১৯৮৪ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন নটবর। রাজীব গাঁধীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারেও হন বিদেশমন্ত্রী, যা প্রায় অবধারিতই ছিল সে সময়। কিন্তু ইরাকের সঙ্গে তেলের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে নটবরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সনিয়া-মনমোহন তাঁকে বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।

তিক্ততার সেই শুরু। বিচারপতি পাঠক কমিটিও তেলের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প তথা ভোলকার-কাণ্ডে নটবরকে দোষী বলে সাব্যস্ত হওয়ার পরে সনিয়া আর পারতপক্ষে কথা বলতেন না তাঁর সঙ্গে। রাগে ফুঁসছিলেন প্রাক্তন এই কূটনীতিক। এখন আত্মজীবনী লিখে গাঁধী পরিবারের সব হাঁড়ির কথা ফাঁস করতে চলেছেন। বস্তুত সেই আশঙ্কা থেকেই নটবরকে নিরস্ত করতে গত ৭ মে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন সনিয়া-প্রিয়ঙ্কা। সাক্ষাৎকারে সে কথা ফাঁস করে দিয়ে নটবর বলেন, “অতীতের ঘটনা নিয়ে সনিয়া দুঃখ প্রকাশ করেন। এ-ও বলেন যে, আপনাকে খুব কাছের বন্ধু হিসেবে গণ্য করতাম। রাহুল-প্রিয়ঙ্কাকেও যা বলিনি, এমন অনেক কথা আপনাকে বলেছি।”

কিন্তু সনিয়ার অনুরোধ যে নটবর রাখলেন না তা এখন স্পষ্ট। বরং বই প্রকাশের আগেই প্রাক্তন এই কূটনীতিক আজ থেকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য ফাঁসে নেমে পড়েছেন। তাঁর কথায়, কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকার গঠনের আগে দশ জনপথে একটি বৈঠক হয়। মনমোহন সিংহ, সুমন দুবের মতো সেই বৈঠকের সাক্ষী ছিলেন তিনিও। প্রিয়ঙ্কাও ছিলেন সেখানে। সনিয়া সে দিনই জানান, রাহুল চাইছে না তিনি প্রধানমন্ত্রী হোন। বরং সেই পদের দাবি যাতে তিনি ছেড়ে দেন, সে জন্য রাহুল ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন তাঁকে। নটবর এ-ও দাবি করেন, মনমোহনকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি ছিল ইউপিএ-র দুই শরিক নেতা লালুপ্রসাদ ও রামবিলাস পাসোয়ানের। কিন্তু অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের রাজি করানো হয়।

প্রশ্ন হল, আজ এত বছর পরে কেন এই সব কথা টেনে আনছেন নটবর? এটা কি প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়? সনিয়া তাঁকে বিশ্বাস করে, কাছের বন্ধু হিসেবে যা যা বলেছেন, সেই গোপনীয়তা ভাঙা কি উচিত ছিল? এই সব প্রশ্নের সামনে পড়তেই হচ্ছে নটবরকে।

সাজিয়েগুছিয়ে কথা বলায় কংগ্রেসে নটবরের জুড়ি মেলা ভার ছিল একটা সময়। আজ তিনি বলেন, “সনিয়া গাঁধী কি যে সে ব্যক্তি! তিনি অন্যতম ক্ষমতাশালী রাজনীতিক। নেহরু-চার্চিলের মতো ঐতিহাসিক চরিত্র। আর ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে কিছু জানা থাকলে তা গোপন করটা ঠিক নয়। এক জন ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সেই অন্যায় করা আমারও উচিত নয়। তাই ৮৩ বছরে পৌঁছে সব লিখে ফেলার কথা স্থির করলাম।”

এখানেই থেমে থাকেননি নটবর। বিজেপির দীর্ঘদিনের অস্ত্র নিজের হাতে তুলে নিয়ে তিনি বলেন, সনিয়া গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হননি ঠিকই। কিন্তু তাঁর হাতেই সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব ফাইল তাঁর কাছে যেত। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পুলক চট্টোপাধ্যায় তাঁর কাছে সব ফাইলপত্র নিয়ে যেতেন। লোকসভা ভোটের মুখে মনমোহনের মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারুর বই ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ সাড়া ফেলেছিল। তাতেও মনমোহনের এই কর্তৃত্বহীনতা ও সব ক্ষমতা সনিয়ার হাতে থাকার কথাই রয়েছে।

নটবর এ-ও দাবি করেন, ’৯১ সালে নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাননি সনিয়া। তাঁর পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন শঙ্করদয়াল শর্মা। কিন্তু শঙ্করদয়াল রাজি না হওয়ার কারণেই নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করতে বাধ্য হন সনিয়া।

নটবরের বই নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে। অনেকেই বইটিকে বলতে শুরু করেছেন ‘এন বোমা (নটবর বোমা)। ৭ অগস্ট বইটি প্রকাশিত হবে। এখন থেকেই একটু একটু করে তার আবহ তৈরি করতে চাইছেন নটবর। আজকের সাক্ষাৎকারের ফাঁকেই জানিয়েছেন, কাল ফাঁস করবেন আরও কিছু তথ্য।

উদ্বেগে রইল গাঁধী পরিবার, সঙ্গে গোটা কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

natawar singh autobiography sonia rahul
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE