Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হেরাট হানায় নওয়াজ আরও চাপে, দিল্লি সফর অনিশ্চিত

সময় বদলায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সেই অগ্নিগর্ভ চিত্রনাট্যটি বারবার ফিরে আসে। আজ ভোররাতে আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় দূতাবাসে জঙ্গি হানার ঘটনা সেটাই আরও এক বার প্রমাণ করে দিল। এই ঘটনার পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভারত সফর আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

সময় বদলায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সেই অগ্নিগর্ভ চিত্রনাট্যটি বারবার ফিরে আসে। আজ ভোররাতে আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় দূতাবাসে জঙ্গি হানার ঘটনা সেটাই আরও এক বার প্রমাণ করে দিল। এই ঘটনার পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভারত সফর আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

কিন্তু আফগানিস্তানে ভারতীয় দূতাবাসে জঙ্গি হানার সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রীর সফরের কী সম্পর্ক?

ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, যখনই দু’দেশ শান্তি আলোচনায় বসার চেষ্টা করে, তখনই পাক কট্টরবাদীদের মদতপ্রাপ্ত জঙ্গিরা এ ভাবে হিংসা ছড়িয়ে গোটা প্রয়াসকে পণ্ড করার চেষ্টা করে। সেই জঙ্গি হানা ভারতেও হতে পারে, আবার আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের উপরেও। গত বছর যেমন রাষ্ট্রপুঞ্জে মনমোহন-নওয়াজ বৈঠকের কয়েক দিন আগে আফগানিস্তানের জালালাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ফলে পরিস্থিতি যথেষ্ট ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। একই ভাবে বাজপেয়ী জমানায় লাহৌর বাসযাত্রার পর পরই ঘটেছিল কার্গিলের যুদ্ধ।

কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, আজ হেরাটে যা ঘটেছে, তাতে ভারতেরও চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আজ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মোদী। তিন দিন পরে কারজাই দিল্লি এলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলেও জানা গিয়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন আজকের হামলার জন্য নাম না-করে পাকিস্তানকেই দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “এই আক্রমণের ফলে আবার প্রমাণ হয়ে গেল, আফগানিস্তানের শান্তি ও সুস্থিতির প্রশ্নে সব চেয়ে বড় বাধা তাদের সীমান্তের বাইরে থেকে আমদানি হওয়া সন্ত্রাস।” এই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার জন্য কাবুলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার কথাও আজ উল্লেখ করেছেন ভারতীয় মুখপাত্র।

তবে এই সঙ্কট ভারতের কাছে যতটা, পাকিস্তানের কাছেও কিছু কম নয়। কূটনীতিকদের একাংশ বলছেন, নওয়াজের চাপ বরং আরও বেশি। কারণ, এ দিন হেরাটে যে জঙ্গি হানা হয়েছে, সেটা আফগানিস্তানকে শিখণ্ডী খাড়া করে আদতে মোদীকেই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা সন্ত্রাসবাদীদের। আর এই সন্ত্রাসবাদীরা প্রায় সকলেই কাজ চালাচ্ছে পাকিস্তানের মাটি থেকে, পাকিস্তানের একটি প্রভাবশালী অংশের মদতে। মোদীর আমন্ত্রণের পরে সেই প্রক্রিয়াকে বানচাল করাই যে এর মূল উদ্দেশ্য, সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে হাফিজ সঈদের কথা শুনলেই। ২৬/১১-এর মূল মস্তিষ্ক হাফিজ সঈদ পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় হিংসাত্মক ভঙ্গিতে মোদীকে আক্রমণ করে চলেছেন। লাহৌরে একটি জনসভা করে হাফিজ সঈদ বলেছেন, “মোদীর মতো নেতা ক্ষমতায় এলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি বিষাক্ত হয়ে যাবে। স্বার্থহীন ভাবে যে কাজ আমরা চালিয়ে যাচ্ছি, তা শেষ হয়ে যাবে।” কূটনীতিকরা তাই বলছেন, ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির যে প্রয়াস নিয়েছেন মোদী, এ দিনের হামলার মধ্য দিয়ে তাকেই রক্তচক্ষু দেখাল পাক সন্ত্রাসবাদীরা। যার ফলে কঠিন হয়ে পড়ল নওয়াজের কাজ।

অথচ ক্ষমতায় আসা ইস্তক ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন নওয়াজ। তাঁকে শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই ব্যাপারে অপ্রত্যাশিত সুযোগও এনে দিয়েছিলেন মোদী। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখন যদি নওয়াজ নয়াদিল্লি আসতে না-পারেন, তবে সেটি তাঁর পক্ষে পরাজয়েরই সামিল হবে। কারণ, তিনি বারবার আসতেই চাইছেন। গত কাল পাক প্রশাসন সূত্রেও জানানো হয়েছিল সে কথা। এ দিন অবশ্য পাক বিদেশ মন্ত্রক চুপ। বরং নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম টুইট করে বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। এর ফলে ভাবনার সীমাবদ্ধতা, অমূলক ভয় ও ভুল বোঝাবুঝি সরিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।’

মরিয়মের এই টুইটকে বকলমে তাঁর বাবার বক্তব্য বলেই মনে করছে একটি অংশ। তাদের বক্তব্য, নওয়াজ যে ভারতে যেতে আগ্রহী, সেটা তাঁর হয়ে বুঝিয়ে দিলেন মেয়ে। পাক বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্রেরও বক্তব্য, “এই সুযোগ হারালে তা বড় ভুল হবে। আমাদের আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” পাক বিদেশ মন্ত্রক এখনও আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত ভারত সফরে যেতে পারবেন নওয়াজ। বুঝিয়ে উঠতে পারবেন দেশের কট্টরপন্থীদের।

এই লড়াইটাই চলছে গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে। পাক সেনাবাহিনী ও আইএসআই নওয়াজের উপরে নাগাড়ে চাপ দিয়ে চলেছে, তিনি যাতে ভারতে না যান।

সেনা-আইএসআই-মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে এই স্নায়ুযুদ্ধটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন নওয়াজ। সফরে কতটা লাভ, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন ক্রমাগত। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে যেতে না পারলে এদের কাছে তো বটেই, পাকিস্তানের তালিবানি শক্তির কাছেও হার মানতে হবে তাঁকে। যার প্রভাব ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপরে পড়তে বাধ্য। আন্তর্জাতিক মহলেও এই সঙ্কেত যাবে যে, হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বলে একদা খ্যাত নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা করার এমন সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন নওয়াজ শরিফ। এবং দেশের মধ্যেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাঁর কর্তৃত্ব।

এখন তাই শ্যাম আর কুলের টানাপড়েনে আটকে আছেন নওয়াজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE