Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

’৬২-র ভূত ফেরালেন ম্যাক্সওয়েল, তপ্ত দিল্লি

আবার সে এসেছে ফিরিয়া। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধে বিপর্যয়ের দুঃস্বপ্ন আমৃত্যু জওহরলাল নেহরুকে ছাড়েনি। সেই দুঃস্বপ্ন এ বার তাড়া করল রাহুল গাঁধীকেও। দিল্লির সাউথ ব্লকের দোতলায় প্রতিরক্ষা সচিবের দফতর ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্স ডিরেক্টরেটের অফিস। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এখানেই তালাবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের তদন্ত রিপোর্ট। ‘টপ সিক্রেট’ এই দলিল কোনও দিনই দফতরের বাইরে বের হয়নি। এমনকী খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীও যদি ওই রিপোর্ট দেখতে চান, তাঁকে আসতে হয় সচিবের দফতরে। বিগত পাঁচ দশকে ভারত সরকার কোনও দিন এই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।

১৯৬২-র ২০ অক্টোবর শুরু হল ভারত-চিন যুদ্ধ। তার পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা।

১৯৬২-র ২০ অক্টোবর শুরু হল ভারত-চিন যুদ্ধ। তার পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ০২:৪৫
Share: Save:

আবার সে এসেছে ফিরিয়া। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধে বিপর্যয়ের দুঃস্বপ্ন আমৃত্যু জওহরলাল নেহরুকে ছাড়েনি। সেই দুঃস্বপ্ন এ বার তাড়া করল রাহুল গাঁধীকেও।

দিল্লির সাউথ ব্লকের দোতলায় প্রতিরক্ষা সচিবের দফতর ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্স ডিরেক্টরেটের অফিস। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এখানেই তালাবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের তদন্ত রিপোর্ট। ‘টপ সিক্রেট’ এই দলিল কোনও দিনই দফতরের বাইরে বের হয়নি। এমনকী খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীও যদি ওই রিপোর্ট দেখতে চান, তাঁকে আসতে হয় সচিবের দফতরে।

বিগত পাঁচ দশকে ভারত সরকার কোনও দিন এই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ২০১০ সালেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিকে সংসদে বলতে শোনা গিয়েছে, এই রিপোর্ট ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তার স্বার্থেই গোপন রাখা হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আজ সেই গোপন রিপোর্টের একাংশ ফাঁস হয়ে গেল।

সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল এই রিপোর্টের একটি অংশ আজ তাঁর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দিয়েছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুকস ও ব্রিগেডিয়ার পি এস ভগতের রিপোর্ট চিন-ভারত যুদ্ধে বিপর্যয়ের জন্য জওহরলাল নেহরুর ভুল নীতিকেই দায়ী করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর সামর্থ্য না বুঝেই নেহরু চিনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি বা ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর সাবধানবাণীতে কর্ণপাত না করেই ভারত-চিন সীমান্ত বরাবর সেনা ঘাঁটি তৈরিতে মন দিয়েছিলেন। যার জবাবে চিন পাল্টা আক্রমণ চালায়।

এই রিপোর্ট ম্যাক্সওয়েলের হাতে কী করে এল? ষাটের দশকে লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার হয়ে ভারতে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। ভারত-চিন যুদ্ধও ‘কভার’ করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বেরোয় তাঁর বই ‘ইন্ডিয়া’জ চায়না ওয়ার’। সারা পৃথিবী জুড়েই আলোড়ন তুলেছিল বইটি। তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব হেনরি কিসিংগার থেকে শুরু করে চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর মতো অনেকেই বইটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। আবার অন্য একটি শিবিরের মত ছিল, বামপন্থী সাংবাদিক ম্যাক্সওয়েল ইচ্ছে করেই মাও জে দং-এর প্রতি তাঁর দুর্বলতাবশত কিছুটা একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।

সেই ম্যাক্সওয়েল এত দিন পরে, এই অশীতিপর বয়সে হঠাৎ ব্রুকস-ভগৎ রিপোর্টটি প্রকাশ করতে গেলেন কেন? ম্যাক্সওয়েলের দাবি, ১৯৬৩ সালে রিপোর্টটি জমা পড়ার পরেই তিনি সেটি হাতে পেয়েছিলেন। ভারতের তিন-তিনটি সংবাদপত্রকে রিপোর্টটি দিলেও তারা ছাপতে রাজি হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল নিজে কেন তাঁর বইতে রিপোর্টটি প্রকাশ করেননি বা এত দিন ওয়েবসাইটে দেননি, সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও প্রকাশিত রিপোর্টটিকে ভুয়ো আখ্যা দেওয়া হয়নি। বস্তুত আজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সরকারি ভাবে এ বিষয়ে মুখই খুলতে চায়নি।

তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আজ রিপোর্টের যে অংশটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তেমন কোনও নতুন তথ্য নেই। সরাসরি রিপোর্টটি উদ্ধৃত না করেও এই সব কথা ম্যাক্সওয়েল আগেই তাঁর বইতে লিখেছেন। রিপোর্টের বাকি অংশে বরং চিন সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, সেনাবাহিনীর কর্মপদ্ধতির ফাঁকফোকর এবং সরকার, সেনা ও গোয়েন্দার মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব নিয়ে পর্যালোচনা থাকার কথা। সেগুলি আজও সমান ভাবে সংবেদনশীল। এর পরের ধাপে ম্যাক্সওয়েল সে সবও প্রকাশ করে দিতে পারেন কি না, সেটা নিয়ে কিছুটা চিন্তায় রয়েছে সাউথ ব্লক। ম্যাক্সওয়েলের কাছে গোপন রিপোর্টের পুরোটাই রয়েছে কি না, সেটাই এখন তাঁদের কাছে কোটি টাকার প্রশ্ন।

পাশাপাশি ম্যাক্সওয়েল কেন এই ভোটের মরসুমকে রিপোর্ট প্রকাশের মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে বেছে নিলেন, সে প্রশ্নও উঠছে। কেউ কেউ এর পিছনে রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন আছে বলেও সন্দেহ করছেন। কারণ, প্রত্যাশিত ভাবেই ম্যাক্সওয়েলের এই বোমা বিজেপির হাতে হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। ম্যাক্সওয়েল নিজে এ দিন প্রকারান্তরে কংগ্রেসকে বিঁধে মন্তব্য করেছেন, “এত দিন রিপোর্ট গোপন রাখার পিছনে অবশ্যই দলীয় রাজনীতি রয়েছে। কোনও পরিবারের যোগসূত্রও থাকতে পারে।”

কিছু দিনই আগে নরেন্দ্র মোদী অরুণাচলে গিয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে চিনকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বেন না। আজ আবার রাহুল গাঁধী অরুণাচলে প্রচারে গিয়েছেন। সেই মুহূর্তে ম্যাক্সওয়েলের ওয়েবসাইট নতুন করে ’৬২-র দুঃস্বপ্নের স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। অরুণাচলের নাম তখন ছিল নেফা। ১৯৬২-র ২০ অক্টোবর চিনা আক্রমণ শুরু হয়েছিল নেফা এবং লাদাখেই। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ এ দিন সে প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, “আমরা চাই পুরো রিপোর্ট প্রকাশ হোক। ওখানে ’৬২-র বিপর্যয়ের জন্য সঠিক ভাবেই নেহরুকে দায়ী করা হয়েছে।” জবাবে কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “বিজেপি সস্তা রাজনীতি করছে। আমরাও প্রশ্ন তুলতে পারি কার্গিলে অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল কেন। কিন্তু তা করতে চাই না।”

তবে একটা কথা অবশ্য কোনও শিবিরই অস্বীকার করতে পারে না। সেটা হল, স্বাধীন ভারতের সামরিক ইতিহাসে ১৯৬২-র যুদ্ধ সবচেয়ে কম আলোচিত এবং সবচেয়ে বেশি অনালোকিত একটি পর্ব। ১৯৫৯ সালে দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নেওয়া এবং চিন-তিব্বত সংঘর্ষ বাড়তে থাকার পরেই ভারতের সঙ্গে চিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অবনতি হয়। লাদাখ ও তৎকালীন নেফায় তৎপরতা বাড়াচ্ছিল চিন। এই পরিস্থিতিতে নেহরু পাল্টা আগ্রাসী নীতি (ফরওয়ার্ড পলিসি) নেওয়ার কথা ভাবেন। ঠিক হয়, ভারতীয় ভূখণ্ডে চিন সেনার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত বরাবর ভারতীয় সেনাঘাঁটি বাড়ানো হবে। এই ভাবনা থেকেই প্রায় ৬০টি ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৪৩টি ছিল ম্যাকমাহন লাইন-এর উত্তরে (পূর্ব হিমালয় অঞ্চলে ভারত-চিন সীমান্তরেখা)।

কিন্তু ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট স্পষ্ট বলছে, নেহরু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের ভাবনা বাস্তবসম্মত ছিল না। রিপোর্টে অভিযোগ ভারত নিজের সেনা-সামর্থ্যের দিকে তাকায়নি। শুধু এই আজগুবি বিশ্বাসে ভর করে এগিয়েছিল যে, চিন সংযত থাকবে, পাল্টা হামলার পথে হাঁটবে না। ফলে চিন প্রত্যুত্তর দিলে কী করা হবে, সামরিক ভাবে তার কোনও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনাই ছকেনি ভারত। এখানে আইবি ও সেনা-গোয়েন্দাদের কথার মধ্যে ফারাকের কথাও রয়েছে রিপোর্টে। নেহরু এবং মেনন আইবি-র কথায় চালিত হয়েছিলেন। সেনার কথায় কান দেননি। এ ব্যাপারে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ ব্রিজমোহন কল-এর ভূমিকাও সমালোচিত হয়েছে। ভারতীয় সেনার দুর্বলতা ও অক্ষমতার কথা তিনি সরকারকে বোঝাতে পারেননি।

চিন যুদ্ধে মুখ পোড়ার পরে কল ও মেননকে সরতে হয়। নেহরু প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন। আজ এত দিন পরে ’৬২-র সেই ভূত নেহরুর চতুর্থ প্রজন্মকেও ধাওয়া করল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

1962 india china war nehru maxwell
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE