২৫ এপ্রিল ২০২৪
Asadharan

পেশায় পুলিশ, নেশায় পরোপকারী, সেবাব্রতী সুকুমারের ‘পরের কারণে মরণেও সুখ’

পেশাগত দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে সামলিয়েও, তাঁর মনের খিদে মেটে না। পেশাগত দায়িত্ব ছাপিয়ে চলে যায় সুকুমারের সামাজিক দায়িত্ববোধ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিদিশা দত্ত
চন্দননগর শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২১ ০৭:২১
Share: Save:

পুলিশ… সুকুমার উপাধ্যায়ের দেখা পেলে অকালপ্রয়াত কবি নিশ্চয়ই ‘...কবিকে দেখে টুপিটা তোর খুলিস’ লিখতেন না। বরং তাঁর মাথাতেই হয়তো সযত্নে পরিয়ে দিতেন উষ্ণীষ।

সুকুমার পেশায় পুলিশকর্মী। বাড়ি বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি। নানা থানার জল খেয়ে এখন কর্মরত হুগলির চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটে। চোর-ছ্যাঁচোড়-ডাকাত-অপরাধী ধরার এই পেশায় তিনি যথেষ্ট সফল। উত্তরবঙ্গ থেকে জঙ্গলমহল, বর্ধমান থেকে হুগলি— কোথায় না কোথায় কাজ করেছেন বছর চল্লিশের এই ‘তরুণ’। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে সামলেও, তাঁর মনের খিদে মেটে না। পেশাগত দায়িত্ব ছাপিয়ে চলে যায় সুকুমারের সামাজিক দায়িত্ববোধ। পকেটের টাকা খরচ করে হলেও সেই কাজ করে চলেন তিনি। আজ থেকে নয়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তিনি অন্য রকম।

এই তো গত মাসের কথা। পুরুলিয়ার মানবাজারের বাসিন্দা চিত্ত মাহাতোকে তিনি নির্বিঘ্নে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দিলেন। বাড়ির লোকজন তো চিত্তের শেষকৃত্য সেরে ফেলেছিলেন সেই কবে। ভেবেছিলেন, মারা গিয়েছেন ওই মধ্যবয়সি। সেই চিত্তকেই গত চার-পাঁচ বছর ধরে চুঁচুড়ার পথেঘাটে ‘ফলো’ করছিলেন সুকুমার। কোথায় যান, কী করেন, কোথায় থাকেন, কার সঙ্গে কথা বলেন, কী কথা বলেন— সব কিছুর নোট রাখছিলেন। কিন্তু কোনও ভাবেই ‘ভবঘুরে’, ‘পাগল’ চিত্তের মনজগৎ এবং ঘড়বাড়ির হদিশ পাচ্ছিলেন না চন্দননগর পুলিশ লাইনে কাজ করা সুকুমার। কিন্তু হাল ছাড়েননি...

স্বীকৃতির মোহ নেই সুকুমারের। শুধু নিজের মতো করে মানুষের পাশে থাকতে চান।

স্বীকৃতির মোহ নেই সুকুমারের। শুধু নিজের মতো করে মানুষের পাশে থাকতে চান। —নিজস্ব চিত্র।

এক দিন সত্যিই সন্ধান পেলেন। সেটাও গত মাসে। সুকুমার বলছিলেন, ‘‘চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে যে দোকানে আমরা চা খেতে যাই, সেখানে রোজ আসতেন। অনেক দিন ধরে। এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। দোকানি এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট দিলে চুপচাপ চলে যেতেন কালো পোশাক, খালি পা, আর চুলে জটা পড়া লোকটা। সে দিন আমার কাছে চেয়ে বসলেন পাঁচটা টাকা। মুড়ি খাবেন। দিলাম। তার পর পাশের দোকান থেকে মুড়ি কিনলেন। আমার কেমন একটা রোখ চেপে গেল। জিজ্ঞেস করলাম— কাকা, বাড়ি কোথায়?’’ চিত্ত জবাব দিয়েছিলেন। সুকুমারের কথায়, ‘‘পুরুলিয়ার উপভাষায় উনি বললেন, মানবাজার।’’ ব্যস, এইটুকুই। তার পর চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন চিত্ত।

সুকুমার তার আগেই জেনে ফেলেছিলেন, চুঁচুড়া হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের পাশে ফুটপাথের উপর একটা বিছানায় রাত কাটান ওই ‘ভবঘুরে’। কখনও কখনও কিছু কিছু পুরনো কথা মনে পড়ে। বেশির ভাগ সময় মনে হত, তাঁর চেতনা জুড়ে শুধুই শূন্যতা। এর পর এক দিন কথায় কথায় চিত্ত মানবাজারের একটা গ্রামের নামও বলেন সুকুমারকে। সঙ্গে নিজের নামটাও। সেই সূত্রেই এক বন্ধুর মাধ্যমে সুকুমার যোগাযোগ করেন ওই গ্রামে। তার পর খোঁজ পাওয়া যায় চিত্তের দাদার। বন্ধুর মোবাইলে চিত্তের ছবি পাঠান সুকুমার। জট পড়া চুল, বুক পর্যন্ত দাড়ি দেখে চিনতে পারেননি তাঁর দাদা। জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ ভাবে চেনা সম্ভব নয়। এর পর সুকুমার চুঁচুড়ার একাধিক সেলুনে কথা বলেন। কেউ ‘গায়ে গন্ধ’ চিত্তের চুলদাড়ি কাটতে রাজি নন! শেষে অনেক অনুরোধে সুকুমার এক জনকে রাজি করাতে পারেন। নেড়া মাথা, নেড়া গাল চিত্তর সেই ছবি পাঠালেন ফের। এ বার চেনা ঠেকল দাদার। কিন্তু ভাইয়ের কাছে আসবেন কী করে? ঘরে যে অর্থাভাব। সে ব্যবস্থাও করে দিলেন সুকুমার। গাড়িভাড়ার টাকা পাঠালেন। ভাইকে দাদার হাতে তুলে দিলেন। তার পর গাড়ি ভাড়া করে পাঠিয়ে দিলেন মানবাজারে। সেটা গত ২৭ অক্টোবর।

সুকুমারের জীবনে এমন উদাহরণ অজস্র। তবে শুরুটা আলাদা করে মনে রাখার মতো। সুকুমার তখন অনেক ছোট। সবে ক্লাস সেভেন। গঙ্গাজলঘাটির যে গ্রামে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই কাপিষ্ঠার পোস্ট মাস্টার বার্ধক্যভাতার টাকা তছরুপ করেছিলেন। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথা ভেবে সুকুমার চিঠি লিখেছিলেন হেড অফিসে। ঘটনার তদন্ত হয় সেই চিঠি পাওয়ার পর। এক বছরের জন্য সাসপেন্ড হন ওই পোস্ট মাস্টার। টাকাও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

এর পর ২০০১ সাল। গুজরাতের ভুজে ভয়াবহ ভূমিকম্প। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। সুকুমার তখন বেকার। কোনওক্রমে ১০০ টাকা জোগাড় করে গ্রামেরই পোস্ট অফিস থেকে মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। মাসখানেকের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রাপ্তিস্বীকার। এর পর ২০০৩ সালে রাজ্য পুলিশে চাকরি। মাইনের টাকা তখন থেকেই নানা কাজে খরচ করেন সুকুমার।

পেশাগত দায়িত্ব ছাপিয়ে চলে যায় সুকুমারের সামাজিক দায়িত্ববোধ।

পেশাগত দায়িত্ব ছাপিয়ে চলে যায় সুকুমারের সামাজিক দায়িত্ববোধ। —নিজস্ব চিত্র।

সুকুমার এ সব ঘটনা মনে রাখতে চান না। জীবনে চলার পথে অন্যের পাশে দাঁড়ানোই তো মানুষ হিসাবে তাঁর কর্তব্য, এমনটাই মনে করেন। যেমন কাপিষ্ঠারই এক পিতৃহারা কিশোর আশ্রয় পেয়েছিল সুকুমারের কাছে। সে ছেলের বয়স এখন আঠাশ। মা-কে নিয়ে তিনি এখন জীবনে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গ্রামের যে সব ছেলেরা শহর কলকাতায় পরীক্ষা দিতে আসেন, বা কাজের জন্য আসার প্রয়োজন পড়ে কলকাতায়, তাঁরা সকলে এখনও সুকুমারের কোয়ার্টারেই ওঠেন। থাকেন। খাওয়াদাওয়া করেন। পরীক্ষা দেন। চলেও যান। নিজের মতো করে তাঁদের সাহায্য করেন সুকুমার।

কাজের সুবাদে সুকুমার যখন পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ে, বেলপাহাড়িতে তখন মাওবাদীদের প্রচণ্ড দাপট। এলাকার অনেক কিশোর-তরুণ-যুবক তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। সুকুমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওই সব গ্রামের একাধিক ‘অনুপ্রাণিত জন’কে আর্থিক সাহায্য করে ব্যবসায় নামিয়েছেন। জঙ্গলমহলের তেমন দিন আর নেই। কিন্তু সুকুমারের সেই বন্ধুরা এখনও তাঁকে মনে রেখেছেন। করোনা-কালে এই চুঁচুড়া-চন্দননগরেই সুকুমার নিজের মোটরসাইকেলে মুড়ি, চিঁড়ে, বিস্কুট, কেক, চকোলেট নিয়ে বেরোতেন। এলাকার ভবঘুরেদের হাতে তুলে দিতেন সে সব খাবার। কয়েক জনকে নিয়মিত চাল-ডাল-তেল-তরকারিও কিনে দিতেন। এক বেকার বন্ধু গাড়ির ব্যবসা করবে বলে নিজের নামে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁকে গাড়ি কেনার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন তিনি।

এ সব কথা তুললেই থামিয়ে দিতে চান সুকুমার। বলেন, ‘‘এ সব করি ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা হোক আমি চাই না। অসহায় মানুষের জন্য এ সব করাটা তো স্বাভাবিক।’’ কিন্তু সেই ‘স্বাভাবিক’ কাজ নিয়ে স্ত্রী কিছুই বলেন না? মাইনের বেশির ভাগটাই তো এ সব কাজে খরচ হয়ে যায়! সুকুমার বলছেন, ‘‘কল্পনা আর আমাদের মেয়ে প্রিয়া— ওদের সমর্থন না থাকলে আমি এ সব করতেই পারতাম না। কোয়ার্টারে তো সব সময় লোকজন আসতেই থাকে। তাদের আপ্যায়নে কল্পনা কোনও ত্রুটি রাখে না।’’

স্বীকৃতির মোহ নেই সুকুমারের। শুধু নিজের মতো করে মানুষের পাশে থাকতে চান। তবে এ সবের মধ্যেই একটা পিঠ চাপড়ানি তাঁকে ভীষণ খুশি করেছে। চিত্ত মাহাতোকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুকুমার-ব্যবস্থার কথা জানতে পেরে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার অর্ণব ঘোষ। সুকুমারের পিঠ চাপড়ে তিনি ‘সাবাশি’ দেন। অফিসারদের বৈঠকে কনস্টেবল সুকুমারকে ডেকে তাঁর প্রশংসা করেন। চিত্তকে বাড়িতে পাঠানোর জন্য খরচের পুরো টাকাটাও দিতে চান তিনি। এমনকি, সুকুমারকে পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নেওয়ার ‘উপহার’ও দিতে চেয়েছেন অর্ণব। সুকুমার সে সব নিতে চাননি। বলছিলেন, ‘‘এক জন ডিআইজি পদমর্যাদার আইপিএস অফিসার আমার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন, ওটাই তো অনেক। আর কী চাই!’’

মানুষের ভালবাসাই আসলে সুকুমারের মাথার উষ্ণীষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE